ব্যাংক খাতে অস্থিরতা, খেলাপি ঋণ, বিনিয়োগ স্থবিরতা, মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানিসংকটে নাজুক দেশের আর্থিক ভিত্তি। বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নানা সূচকে নেমে এসেছে উদ্বেগের ছায়া, বেড়েছে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। চলমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নীতিগত দুর্বলতা যোগ হয়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতির মন্দা কোনোভাবেই কাটছে না।
ব্যাংক খাতে অস্থিরতা : নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মোট ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর চরম তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। এখনো সেই চাপ সামলে উঠতে পারেনি কিছু ব্যাংক। এসব দুর্বলতার মধ্যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করতে কাজ চলছে প্রথম ধাপে।
পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের আমলে ব্যর্থ হওয়া পদ্ধতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে আলোচিত ও বিতর্কিত এক ইস্যু ‘মার্জার’ বা একীভূতকরণ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৪ সালের শেষ ভাগ থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যদিও এর লক্ষ্য ব্যাংক খাতকে আরো সুশৃঙ্খল ও স্থিতিশীল করা; তবে বাস্তবে এই সিদ্ধান্ত গ্রাহক, কর্মকর্তা ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি করেছে। কারণ ইতিহাস বলছে, একাধিক প্রতিষ্ঠান মার্জ হলে কিছু না কিছু কর্মকর্তার চাকরি হারানো নিশ্চিত।
খেলাপি ঋণে নতুন রেকর্ড : বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আবারও নতুন এক বিপজ্জনক রেকর্ডে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মাত্র তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এই ঋণের হার এখন দাঁড়িয়েছে মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪.১৩ শতাংশে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় বিপজ্জনকভাবে বেশি। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এত দিন লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ এখন বেরিয়ে আসছে।
নীতি সুদহার বেড়ে ঋণ ব্যয় বেড়েছে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। সর্বশেষ তা দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে, যা দেশের ইতিহাসে অন্যতম উচ্চহার। এতে উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, ফলে বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। কারণ ব্যাংকঋণ নিতে গেলে সুদ গুনতে হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি না কমা পর্যন্ত নীতি সুদহার ১০ শতাংশে রাখা হবে। মূল্যস্ফীতি কমলে নীতি সুদহার কমানো হবে। গভর্নর বলেছেন, ‘ব্যবসায়ীরা চাপ দিলেই যে সুদহার কমিয়ে দেব, তা হবে না। আগে মূল্যস্ফীতি কমবে, তারপর পলিসি রেট ধীরে ধীরে কমানো হবে।’
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে খরা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৫০ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.৪০ শতাংশ কম। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ব্যাংকগুলোর বেসরকারি ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ২১ হাজার ৮২২ কোটি, যা মার্চ মাসে ছিল ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৫১২ কোটি টাকা।
মার্চে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৫৭ শতাংশ, যা জুলাই-আগস্টের পটপরিবর্তনের পর টানা আট মাস ধরে নিম্নমুখী প্রবণতায় ছেদ টেনেছিল। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬.৮২ শতাংশ। তার আগের মাস জানুয়ারিতে এই খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.১৫ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। দারিদ্র্য বিমোচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক কালে দেশের বেসরকারি খাতের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। ব্যাংকঋণই ব্যবসায়ীদের প্রধান ভরসা। কিন্তু সেখানে সুদহার বেশি। বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারের অবস্থাও ভালো না।’
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হলো বেসরকারি খাত। শিল্পের উৎপাদন, বিপণন কিংবা সেবা খাতের বেশির ভাগই বেসরকারি খাত নির্ভর। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে খাতটিকে ঋণবঞ্চিত করা হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
বিদেশি বিনিয়োগেও ধস
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ডলার সংকট ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে কমেছে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই)। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৯১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭ কোটি ডলার কম। কারণ গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১২৮ কোটি ডলার, হিসাব অনুযায়ী যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৮.৯০ শতাংশ কম।
আইএমএফের শর্ত পালনে সর্বনাশ
২০২৩ সালে যুদ্ধ-উৎকণ্ঠাপূর্ণ বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে রিজার্ভ সংকট থেকে বাঁচতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করেছে বাংলাদেশ, যার বিপরীতে কাঠিন্যপূর্ণ শর্তগত সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে। ব্যাংকিং খাত সংস্কার, রাজস্ব কাঠামোর পরিবর্তন, অগ্রিম ঋণের শর্ত হিসেবে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারনির্ভর করা, রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার—এসব শর্তের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। তবে শর্তগুলো কঠোর বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে দেখা গেছে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে প্রভাব পড়ছে। টাকার বিপরীতে বেড়েছে ডলারের মূল্য। কয়েক ধাপে বেড়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম, যা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে সাধারণ জনগোষ্ঠীর ওপর। এই ‘জনসম্পৃক্ত’ শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকিও বেড়েছে।
রিজার্ভ স্থির, কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত নয়
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও তা এখনো তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। জুন ২০২৫-এ রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯.৮ বিলিয়ন ডলারে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এই পরিমাণ যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
জ্বালানিসংকটে উৎপাদন ব্যাহত
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতির কারণে শিল্প-কারখানায় নিয়মিত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, সিরামিক, ওষুধ ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাতে বিদ্যুত্সংকট বড় প্রভাব ফেলছে। এর প্রভাব পড়ছে রপ্তানিতেও।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, ‘কলকারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির সার্বিক অবস্থার এখনো উন্নতি না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কম। তাঁরা ওয়েট অ্যান্ড সি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।’ এ ছাড়া ব্যাংকের ঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় ব্যবসা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে
চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দীর্ঘ সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী। মে ২০২৫-এ সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫ শতাংশ, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
ব্যাংকে আস্থার সংকট কিছুটা কাটলেও উদ্বেগ আছে
২০২৪ সালের শেষ ভাগে কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকটের কারণে আমানতকারীদের মধ্যে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি কাটেনি।
চলতি মাসের শুরুতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এই বাজেটে ব্যবসায়ীরা মোটেই খুশি নন।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘নতুন বাজেটটি সংকুচিত ধরনের বাজেট। গত ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো এর আকার কমানো হয়েছে। বাজেট দেশের পুরো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না। বাজেট হলো আয় ও ব্যয়ের হিসাব। বাংলাদেশের মোট জিডিপি যদি দেখি, এটা হলো ৫০০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাজেট মোট জিডিপির ১২-১৪ শতাংশ। একটা উন্নত দেশের বাজেট মোট জিডিপির ২০ থেকে ২২ শতাংশ হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে গড়ে তা ১১ থেকে ১২ শতাংশ।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ। মজুরির হার বাড়ছে মাত্র ৭ শতাংশ। একটা দেশে মজুরির হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতি যদি বেশি থাকে, তাহলে তার অর্থ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। আয় বেশি না হলে সঞ্চয় বাড়বে না। বিনিয়োগও হবে না। সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। সে ক্ষেত্রে সঞ্চয় হবে আধা শতাংশ। যে সঞ্চয় হবে, তা ব্যাংকে রাখলে বিনিয়োগ উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারবে। সঞ্চয় না বাড়লে বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগের জন্য একটা সুস্থির পরিবেশ দরকার। দেশে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি দিন দিন কমে যাচ্ছে। সরকার বলেছে, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আমরা দেখতে চাই, বিনিয়োগ কতটুকু বৃদ্ধি পায়।’
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ