কক্সবাজারের ময়নারঘোনা ক্যাম্পের বয়োবৃদ্ধ হান্ডা মিয়া। বয়স তাঁর ১২০ বছর। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়ছেন বেশ। নিজের দুই সন্তানের কাঁধে ভর করেই ‘অগ্নিমুহুর্তের’ আঙিনা থেকে ফেরা। কিন্তু শেষ রক্ষায়ও জীবন নিয়ে আছেন চরম হতাশায়। বয়সের রুষ্টতা পিঁছু ছাড়ছে না তার। ক্যাম্পের একটি তাবুর কোণেই কোনো রকম দিন পার করছেন তিনি। আক্ষেপ করে বললেন, ‘জান নিয়ে বেঁচে আইছি, এখন কোনো রকম সময় পার করা। ভাল-মন্দ দেখার সুযোগ কই। যে খারাপ অবস্থায় আছি, কখন যে মরে যাই তার হিসাব নাই।’ একই ক্যাম্পে ১১৫ এবং ১১০ বছর বয়সী প্রবীণও আছেন বলে জানা যায়।
নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা বয়োবৃদ্ধ রোহিঙ্গাদের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তাদের এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। দিনের বেলায় কোনো রকম পার করতে পারলেও রাত আসার সঙ্গে সঙ্গেই নেমে আসে অন্ধকারের কালো ছায়া। অবহেলা, অনাদরে কোনো রকম সময় পার করছেন। বঞ্চিত নাগরিক নানা সুবিধা থেকে। ক্ষেত্র বিশেষ উপেক্ষিত স্বয়ং স্বজনের কাছেও।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এন এন জোনে গিয়ে দেখা যায়, এ জোনের একটি তাবুর কোণো নিজেকে গুটিয়ে রেখে বসে আছেন প্রবীণ গোলাম নবী (৯৫)। কথা হয় এ ক্যাম্পে কাজ করা উন্নয়ন কর্মী রোজিনা আকতারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে অনেক প্রবীণকে অপরিস্কার জায়গায় অবহেলা-অনাদরে ফেলে রাখা হয়েছে। জীবনের মান বলতে তারা হয়তো ভুলেই গেছেন। গত বুধবারও একজন প্রবীণকে আমি তার হাত ও পায়ের নখ কেটে দিয়েছি। তারা বড়ই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।’ কেবল গোলাম নবী নন, এ রকম প্রায় প্রতিটি ক্যাম্পের তাবুতেই বয়োবৃদ্ধরা হাত-পা গুটিয়ে কোনো রকম বসে-শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন। প্রয়োজনীয় খাবার কখনো মিলছে, কখনো মিলছে না। প্রহর গুণছেন শেষ যাত্রার।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, ‘বয়োবৃদ্ধদের বিষয়টি আমাদের বিশেষ নজরে আছে। তারা এখানে এসে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তবে তাদের নিয়ে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায় থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি তাদের দৈনন্দিন জীবনের যে সমস্যা হচ্ছে তা কেটে যাবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইংরোিজ অক্ষর ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ ‘ডি’ দিয়ে ২০টি জোনের নামকরণ করা হয়েছে। প্রতিটি জোনে আছে ৮টি করে ব্লক। প্রতিটি ব্লকে আছে ১৫টি করে উপ ব্লক। প্রতিটি উপ ব্লকে আছে ১০০টি করে তাবু (ঘর)। কেবল টি টি জোনের আটটি ব্লকেই আছে প্রায় নয় হাজার পঞ্চাশোর্ধ নারী-পুরুষ। প্রায় প্রতিটি তাবুতেই আছে পঞ্চাষোর্ধ বৃদ্ধ মানুষ।
এসব বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসার রোহিঙ্গা রেসপন্স প্রজেক্টের ফোকাল পার্সন মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ৮ শতাংশ বৃদ্ধ নারী-পুরুষ রয়েছে। যারা বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন। তবে এসব বয়োবৃদ্ধদের জন্য ইপসার উদ্যোগে ‘প্রবীণ-বান্ধব কেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়েছে। নির্দিষ্ট কেন্দ্রের বয়োবৃদ্ধদের দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা ও বিনোদন। তাছাড়া দৈনন্দিন জীবনে তাদের সমস্যা, সমস্যার প্রকারভেদ, শারীরিক অবস্থা, বয়স উপযোগী খাদ্য পাচ্ছে কিনাসহ এ জাতীয় মৌলিক প্রয়োজনীয়তা নিরুপণ করার কাজ চলছে।’
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে আসেন। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদসংকুল অবস্থায় পড়তে হয় বৃদ্ধদের। প্রবীণরা কেউ আসেন সন্তানের কোলে করে, কেউ আসেন পীঠে চড়ে। অতিশয় অনেক বয়োবৃদ্ধকে আনা হয়েছে দুইজনের কাঁধে ভর করে। তাছাড়া পরিবার নিয়ে আসার সময় বয়োবৃদ্ধ দ্রুত হাঁটতে না পেরে পেছন থেকে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাও আছে। একই সঙ্গে অনেক প্রবীণকে ফেলে চলে আসার দৃষ্টান্তও আছে বলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
বিডিপ্রতিদিন/ ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৭/ ই জাহান