কিছু প্রভাবশালী ব্যাংক মালিকের নির্বিচার লুটপাট, অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ব্যাংক খাতের প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা তাঁদের পকেটে গেছে। তাঁরা যোগসাজশে একে অপরের ব্যাংক থেকে ঋণের আড়ালে নামে-বেনামে লুটে নিয়েছেন এই বিপুল অঙ্কের আমানতের টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ব্যাংক পরিচালকদের দখলেই রয়েছে প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির প্রায় ৪৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সরকার বদলের আগে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সমন্বিতভাবে দুই লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছিলেন। গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠিত হওয়ায় মাত্র চার মাসে সেই ঋণ কমে দাঁড়ায় এক লাখ ৭৫ হাজার ১৩৫ কোটিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতে এত বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে খেলাপির পেছনে মূলত পরিচালকদের মধ্যে সমঝোতা ও আইনগত দুর্বলতাই দায়ী। নিজেদের ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নেওয়ার সীমাবদ্ধতা থাকলেও অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে সমন্বয় করে একে অপরের ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ আদায় করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই পরিচালকরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে সুবিধা নিয়েছেন। আইন সংশোধন ছাড়া এ ধরনের অপব্যবহার বন্ধ হবে না।’
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘যদি কেউ ব্যাংক থেকে তাঁর পরিচালক পদ হারান তাহলে তাঁর ঋণগুলো আর পরিচালক ঋণ থাকে না। তিনি সাধারণ গ্রাহকে পরিণত হন। সে কারণে পরিচালকদের ঋণের খাতা থেকে তাঁর নাম স্থানান্তর করা হতে পারে। তা ছাড়া অনেক গ্রাহকই এখন ঋণ পরিশোধের জন্য যোগাযোগ করছেন। এরই মধ্যে আমাদের ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে একটি বড় গ্রুপ, যারা দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচিত। এখন এসব সমস্যা সমাধানে ঋণের বিপরীতে রাখা জামানতের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা দরকার। তারপর সেগুলো বিক্রি করে সুষ্ঠুভাবে আমানতকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। যদিও এভাবে ঋণের সব টাকা আদায় করা সম্ভব হবে না, তার পরও করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে কেউ এ রকম দুঃসাহস দেখাবে না।’
এ বিষয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুস সাদাত বলেন, ‘পরিচালক বা সাধারণ গ্রাহক যে-ই হোক না কেন, আমরা সবার বিরুদ্ধে মামলা করে ফেলেছি এনআই অ্যাক্ট ও অর্থঋণ আদালতে। আর যাঁরা ঋণ শোধ করতে রাজি হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাদা চুক্তি হয়েছে। এতে আমাদের ব্যাংকের আদায় আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে। মামলা করার কারণে আবার অনেকে ঋণ শোধ করতে এগিয়ে আসছেন।’
তথ্য-উপাত্ত বলছে, ব্যাংক খাতে যেসব গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম এস আলম, বেক্সিমকো ও নাসা গ্রুপ। এস আলম গ্রুপ ব্যাংক দখল করে পরিচালনা পর্ষদ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বিরাট ঋণ আদায় করে। বেক্সিমকোর চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারও ছিলেন এই লুটপাটের নেতৃত্বে।
২০১৬ সালে ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ ছিল ৯০ হাজার কোটি টাকা। এস আলমের উত্থানের পর মাত্র আট বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় দুই লাখ ৩৫ হাজার কোটিতে। এটি প্রায় ১৬০ শতাংশ ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধি।
পটপরিবর্তনের পরবর্তী চিত্র
২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পতনের পর প্রায় ১১টি প্রভাবশালী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংক পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এর ফলে শুধু চার মাসে পরিচালকদের ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকা কমে যায়। তবে অনেকেই শেয়ারহোল্ডার হিসেবে থেকে যাওয়ায় তাঁদের নেওয়া ঋণ ব্যাংক মালিকদের দখলেই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘আটটি ব্যাংকের পরিচালকরা মোট পরিশোধিত মূলধন দিয়েছেন দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা, অথচ তাঁরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এটাই দুর্নীতির আসল প্রতিচ্ছবি।’
আইন ছিল, প্রয়োগ ছিল না
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় বলা হয়, একজন পরিচালক তাঁর নিজ ব্যাংক থেকে পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারবেন না। কিন্তু সেই আইন উপেক্ষা করে সমন্বিত কৌশলে গ্রুপভিত্তিক ঋণ লুটের মহোৎসব চলে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘আগস্টের আগে ব্যাংক খাতে যা ঘটেছে তা সবার জানা। আমরা এখন ব্যাংক খাতের ঘুরে দাঁড়াতে বিভিন্ন সংস্কারে কাজ করছি।’
যদিও ব্যাংক পর্ষদে পরিবর্তনের ফলে পরিচালকদের ঋণ কিছুটা কমেছে, কিন্তু শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, শেয়ারহোল্ডারদের দেওয়া গোপন ঋণসহ প্রকৃত পরিচালক ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বিভিন্ন ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যাংক পরিচালকদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা বা ঋণ দিয়ে শীর্ষ অবস্থানে ছিল এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। আর দ্বিতীয় অবস্থানে নাসা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংকটি থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। তৃতীয় স্থানে থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ নেন ১০ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রুপের পরিচালকরা নেন ১০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সাইথইস্ট ব্যাংক থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ