নরসিংদীতে কৃষকদের ফসলি জমি দখল করে বাগান বাড়ি তৈরি করেছেন এক চেয়ারম্যান। সৌন্দর্যবর্ধনে বাংলোর সম্মুখ ভাগে ৩ বিঘা জমিতে খনন করেছেন পুকুর। বাগান বাড়ির প্রবেশ পথে তৈরি করেছেন পাকা সড়ক। চেয়ারম্যানের এই বাড়ি তৈরিতে বলি হয়েছেন স্থানীয় একাধিক কৃষক। জমি জবর-দখলে বাধা বা পুলিশের কাছে গেলেই কৃষকদের উপর নেমে আসে হামলা মামলাসহ নানা নির্যাতন। জমি রক্ষায় চেয়ারম্যানের হাতে পায়ে ধরেও শেষ রক্ষা হয়নি। তাই প্রতি বছর দু'ফসলি জমির শস্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। তবে দুই বিঘা জমি ভাড়া আর বাকি সবই নিজস্ব এবং ক্রয়কৃত জমিতেই বাগান বাড়ির নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নরসিংদী সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেহেরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হাসান।
এর আগে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে জমি দখলের অভিযোগে চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হাসান বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন দেলোয়ার হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী। চেয়ারম্যানের নানা অনিয়ম তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুনীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী ও খোদ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত ৪ সদস্য।
জানা যায়, এক সময় ইসলামী শাষনতন্ত্র আন্দোলনের তুখোড় নেতা ছিলেন বর্তমান মেহেরপাড়া আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হাসান। স্রোতের ধারায় গাঁ ভাসিয়ে সে তৎকালীন সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জাকারিয়ার হাত ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে নরসিংদী সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। আওয়ামী লীগের গণজোয়ারে সময় ২০১৬ সালে মাহাবুবুল হাসান স্থানীয় এমপি আনোয়ারুল আশ্রাফ খান দীলিপের আর্শীবাদে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চেয়ারম্যান নিজস্ব গেরিলা বাহিনী গঠন করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। অতি সম্প্রতি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বগানবাড়ি করে পুনরায় আলোচনায় আসে মেহেরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহাবুব হাসান। চৌয়া গ্রামের কৃষকদের কয়েক বিঘা ফসলী জমি দখল করে নেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই জমিতে তৈরি করা হচ্ছে বাংলো। প্রায় ৬ বিঘা জমির উপর নির্মিত বাগান বাড়ি তৈরি করতে একাধিক হতদরিদ্র কৃষকের জমি দখল করা হয়েছে। যারা জমি দিতে বাধা দিয়েছেন তাদের উপর চালানো হয় নির্যাতন।
মেহেরপাড়ার চৌয়া গ্রামের আবুল হোসন বলেন, চেয়ারম্যানের অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই রাতে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। জেলে পচে মরবো। পরে বউ বাচ্চা না খেয়ে মরবে। তাই মুখ বুঝে সহ্য করি। একই গ্রামের রহিমা বেগম বলেন, বাগান বাড়ি তৈরি করতে আমার তিন কানি জমি দখল করেন চেয়ারম্যান। যে পুকুরটি খনন করছে চেয়ারম্যান, সে জায়গাটি আমার। পারিবারিক বিষয় নিয়ে বিচারের নাম করে আমার স্বামী ও ছেলেকে অনেক মারধর করেন চেয়ারম্যান। পরে নগদ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করেন। কিন্তু এত টাকা দিবো কিভাবে? তখন চেয়ারম্যান আমার তিন খানি জায়গা তার কাছে বিক্রি করতে বলে। আমি বললাম এ জমি বিক্রি করবো না। তখন সে বলে, ভাড়া দিতে, তাতে ও রাজি না হলে জোর করে আমার জমি দখল করে পুকুর খনন করেন।
ক্ষতিগ্রস্ত মো. জাহাদ আলী বলেন, ''চেয়ারম্যানের বাগান বাড়ির ভেতরে আমার সাড়ে ১৫ শতাংশ বসত ভিটা রয়েছে। চেয়ারম্যান আমাকে ডেকে বলেছে, আমার জমিটি তাকে লিখে দিতে। আমার বাড়ির জন্য তার বাগান বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমি তাকে জায়গাটি লিখে দেইনি বলে আমার বাড়ির চারদিকে দিকে বেড়া দিয়ে রেখেছে। এখন আমি বাড়ি নির্মাণের জন্য ইটা বালু কোন কিছুই আনতে পারছি না। রাস্তার মধ্যে ইটের ট্রাক আটকে দিচ্ছে চেয়ারম্যানের লোকজন। বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে লাইন দিচ্ছে না।''
অন্যদিকে, মুজিবুর রহমান নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ''আমার সাড়ে ২২ শতাংশ জমির মধ্যে ১৪ শতাংশ জমি দখল করে বাগান বাড়িতে পুকুর খনন করেছেন। আমাকে একবার মুখের কথা বলেননি তিনি।''
এদিকে, চেয়ারম্যানের দখলদারিত্বের হাত থেকে রক্ষা পাননি আসিয়া বেগমদের ৫ ভাই-বোনের বসত ভিটার জমিটিও। তিনি বলেন, ''আমাদের এ বসত-বাড়ি হারালে বস্তিতে গিয়ে থাকতে হবে। চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে তার হাতে পায়ে ধরেছি। কিন্তু চেয়ারম্যানের মন গলেনি। আমাদের বাড়ি থাকলে নাকি তার বাগান বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হবে। এখন আমরা কি করবো।''
এদিকে, ফসলী জমির মাটি বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটায়। দলীয় প্রভাব বিস্তার করে স্কুলের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে আওয়ামী লীগের কার্যালয়। শুধু গ্রামের কৃষকই নয়। চেয়ারম্যানের নির্যাতনের হাত থেকে বাদ পড়েননি মেহেরপাড়া ইউপি সদস্যরাও। তাই চেয়ারম্যানের অপকর্মের বিষয়য়ে মুখ খুললেন তারা।
৭ নং ওয়াডের ইউপি সদস্য দানিছুর রহমান দানা বলেন, চেয়ারম্যান যে বাগান বাড়িটি করছে সেখানে অল্প কিছু জায়গা ক্রয় করেছে, বাকিগুলো জোরপূর্বক দখল করেছে। চেয়ারম্যানের পেশীশক্তি বেশি। সবসময় সাধারণ জনগণকে হুমকির উপর রাখে। তিনি আরো বলেন, চেয়ারম্যান স্কুলের জায়গা দখল করে আওয়ামী লীগের কার্যালয় তৈরি করেছে। তার বিরুদ্ধে মুখ খোলা যায় না। আমরা এলাকায় শান্তি চাই।
এর আগে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে জমি দখলের অভিযোগ এনে চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হাসান বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়েরসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুনীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার বরাবর দেলোয়ার হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকে আমি আওয়ামী লীগ করি। কিন্তু এখন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরিচয় দেয়া যায় না। চেয়ারম্যান আমার জমি দখল করে নিয়েছে। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ে বার বার অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়নি।
অভিযোগ অস্বীকার করে মেহেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হাসান বলেন, আমার নিজস্ব এবং ক্রয়কৃত জমিতেই বাগান বাড়ির কাজ করছি। সেখানে দুই বিঘা জমি ভাড়া নিয়েছি। আমার প্রতিপক্ষরা ষড়যন্ত্র করে এসব অপপ্রচার করতে পারে। তারা কোন প্রকার প্রমাণ দেখাতে পারবে না। তিনি আরো বলেন, কাগজ যার, জমি তার। এটাই বাস্তবতা। আমি বিচারক। আমি যদি রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ করি তাহলে আল্লাহর কাছেও জবাবদিহি করতে হবে।
বিডি-প্রতিদিন/মাহবুব