নেক কাজ নেক কাজের সহায়ক, গুনাহ গুনাহের সহায়ক। তাই কোনো একটি ভালো কাজ করলে তা অন্য একটি ভালো কাজের সহায়ক হয়। একটি গুনাহ করলে তা ৫০টি গুনাহ টেনে আনে। আমি একটি মানুষকে হত্যা করতে চাইলে আরও বহু গুনাহ করতে হবে। চিন্তা করতে হবে হত্যা করার জন্য কী অস্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে, তা কোথায় পাওয়া যাবে, কত টাকা দিয়ে আনতে হবে ইত্যাদি চিন্তাভাবনা করতে হয়। নেক কর্ম তেমনই। একটি নেক কাজ বহু নেক কাজের কারণ হয়। যেমন ধরুন, আপনি নিয়ত করেছেন এই মজলিশে আসবেন। এখন আপনার এখানে আসার জন্য দুটি কাজ করতে হচ্ছে (১) রাস্তা দিয়ে আসা (২) অতঃপর মাহফিলে এসে বসা। সবকিছুর চাহিদা ছেড়ে আপনি এসেছেন। দীনি আলোচনা শোনার পর মনের মধ্যে হয়তো পরিবর্তন আসবে যে, বাসাতে গিয়ে আমল করব, অন্যকে আমলের কথা বলব। এবার তাহলে দেখুন, একটি নেক আমল কতগুলো নেক আমলের কারণ হলো। পথে হেঁটে আসা একটি নেক আমল, মজলিশে বসা ভিন্ন একটি নেক আমল, এরপর ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করা আরেকটি নেক আমল। এরকম বহু নেক আমল যুক্ত হয়েছে আপনার এই দীনি আলোচনা শুনতে আসার সঙ্গে। যে কথাটি বলছিলাম তা হলো, প্রত্যেকটি বান্দার বিশেষ একটি নেক আমলের সঙ্গে অন্য নেক আমল অপেক্ষা বেশি অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হয়। তাই সব ধরনের নেক আমলকারী বান্দাকে যখন জান্নাতের একাধিক গেট দিয়ে ঢাকা হবে তখন দুনিয়াতে তার মন যে আমলের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিল, সেই আমলকারীদের জন্য নির্দিষ্ট গেট দিয়ে সে প্রবেশ করবে।
আল্লাহ কাফেরদের তথা পাপীদের জোড়ায় জোড়ায় সমবেত করতে ফেরেশতাদের নির্দেশ দেবেন। পাপিষ্ঠদের সঙ্গে তাদের উপাস্যদেরও উপস্থিত করতে বলবেন। যারা সূর্যের, গাভির, তুলসী গাছের, ভূতের, চন্দ্রের উপাসনা করে, দুনিয়ার মানুষের অনুগত্য করে, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অনুসরণ বাদ দিয়ে তা নেতাদের পেছনে ঘোরে আল্লাহ তাদের সবাইকে উপস্থিত করাবেন। কোরআনে কারিমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে, তোমাদের কী হলো; একে অপরকে সাহায্য করছো না যে? বস্তুত সেদিন তাদের কোনো বন্ধু ও সাহায্যকারী থাকবে না। অনেক সময় মানুষের চিন্তায় আসে যে, এটা কি সম্ভব? ছেলে-মেয়ে এত আদরের ছিল, কিন্তু আমাদের বিপদের সময় কি তারা একটু সাহায্য করতেও আসবে না? হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর সামনে এক দিন আল্লাহর রসুল (সা.) বলছিলেন যে, হাশরের ময়দানে সমস্ত নারী-পুরুষ উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকবে। এ কথা শুনে হজরত আয়েশা (রা.) লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললেন। এরপর প্রশ্ন করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! এটা কেমন কথা যে, একজন অপরজনের প্রতি চেয়েও দেখবে না? আল্লাহর নবী উত্তর দিলেন, পৃথিবীর মানুষের বহু কষ্টের সময় আছে। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কষ্টের সময় হলো মহিলাদের প্রসবের সময়। হাদিসে এসেছে, কোনো মহিলা সন্তান প্রসবের সময় যদি মৃত্যুবরণ করে, তাহলে সে শহীদের মর্যাদা পাবে। মহিলাদের প্রসব ব্যথা মারাত্মক। অনেক সময় মহিলা মারা যায়। কিন্তু হাশরের ময়দানের কষ্ট ও ব্যথা এত বেশি হবে যে, দুনিয়ার প্রসব ব্যথাও অনুভূত হবে না হাশরের মাঠের যন্ত্রণার কারণে। মানুষ যদি ভয় পায় তাহলে ছোট বিপদের কথা ভুলে যায়। সেদিন এমন এক অবস্থা হবে যে, কেউ কারও প্রতি চেয়ে দেখবে না। সবাই নিজের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত থাকবে। হাশরের ময়দানে একজন অপরজনকে সাহায্য করবে না, সবাই নতশির অবস্থায় আল্লাহর সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এরপর একজন অপরজনের সঙ্গে ঝগড়া করবে এবং বলবে, তুমি আমাকে ধ্বংস করেছো, তুমি আমাকে গোমরাহ করেছো, আমাকে আল্লাহর নাফরমানি করতে শিখিয়েছিলে। ছেলে, মা-বাপকে বলবে, তোমরা দুজন আমার দ্বারা স্বার্থ উদ্ধার করেছো। আমাকে ধ্বংস করেছো। ছাত্র ওস্তাদকে বলবে যে, আপনার ভুল দিকনির্দেশনার কারণে আমার জীবন ধ্বংস হয়েছে। মুরিদ বলবে পীর সাহেবকে, আপনি আমার পকেটের প্রতি চেয়ে থাকতেন। কিন্তু আজ আমি বিপদগ্রস্ত, আপনি আমার দিকে চোখ ফিরেও তাকাচ্ছেন না। এভাবে একে অপরকে ধরবে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না। অনেক লোক পীরের মুরিদ, কিন্তু গুনাহ একটাও ছাড়ে না। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, গুনাহ করেও হুজুরের সঙ্গে আছি। হুজুর যদি জাহান্নামে যায় তাহলে আমিও জাহান্নামে যাব। এরা টুপি মাথায় দেওয়া বিভিন্ন মাজারের গোমরাহ ও ফাসেক-ফুজজারদের হুজুর মনে করে। তাদের হাদিয়া দেয় আর মনে করে এই হুজুরের পিছে পিছেই জান্নাতে চলে যাবে। হায়রে বোকার দল! জান্নাতে যাওয়া কি এত সহজ?
অনেক মানুষকে দেখা যায় দীনদার, নামাজ-রোজা, দান-খয়রাত সবই করে কিন্তু বিভিন্ন নাজায়েজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি হিসেবে দাওয়াত করলে অমত করে না, বেপর্দায় ভরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়। এখানে তার দীনদারির খবর নেই। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘কী করি হুজুর! সামাজিকতার কারণে না যেয়েও পারি না। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অসন্তুষ্ট হয়, অনেক কিছু বলে’। কোরআন আপনাকে লক্ষ্য করে কী বলছে দেখুন! বলছে যে, হাশরের ময়দানে আপনার ওসব বন্ধুবান্ধবদের বলা হবে একটু সাহায্য করার জন্য কিন্তু তারা কেউ আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। একজন অন্যজনের ওপর শুধু দোষ চাপানোর চেষ্টা করবে। অধীনস্থ যারা তারা মালিকদের বলবে, আমরা বিপদগ্রস্ত তোমাদের কারণে। তোমরা আমাদের যুক্তির মাধ্যমে বুঝিয়ে আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত করতে। এখন আমাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছো কেন? আমাদের এই কঠিন বিপদের সময় সাহায্য করো না কেন?
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ