১১ আগস্ট বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াত হোসেন এক বক্তব্য দিয়ে বড়সড় একটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ একটা বিশাল পার্টি। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত তার অবদান অস্বীকার করা যাবে না। এই দলকে আমরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করিনি। তারা নিজেদের দল গঠন করতেই পারে নতুন নেতৃত্বের অধীনে। এর আগে অন্য কোথাও বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অথবা অন্য কোনো উপদেষ্টা বলেছেন- আমাদের সরকার দল নিষিদ্ধ করা পছন্দ করে না।
বলাই বাহুল্য তার এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। যে দলের গুণগান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করেছেন, বিগত ১৫ বছর ধরে তারাই এ দেশ শাসন করেছে। তাদেরকে উৎখাত করেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে, যার উপদেষ্টাদের একজন হচ্ছেন তিনি। এ শাসন ছিল জবরদস্তিমূলক, ফ্যাসিবাদী। তাদের ক্ষমতায় আরোহণ ছিল বেআইনি, অবৈধ। ১৫ বছর ধরে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তারা লুটপাট, খুন, ডাকাতি, রাহাজানি এমন কিছু নেই যা করেনি। এবং সবশেষে এক নদী রক্ত সাঁতরে বাংলার শিক্ষার্থী ও জনতা তাদের পরাজিত করেছে। এত নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতার সঙ্গে তারা তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের হত্যা করেছে যার কাহিনি এখনো প্রায় প্রতিদিন মিডিয়াতে ভাসছে এবং মানুষের চোখে অশ্রু ঝরাচ্ছে। এত নৃশংস পুলিশের সেই অত্যাচার, খুন নিপীড়ন, যা মানুষের বুকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এ আগুন নিভছে না। যেমন এতদিন পরেও শুকাচ্ছে না রক্তের দাগ। এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
৫ জুলাই ইতিহাসের নিকৃষ্টতম স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে যেদিন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত এ বক্তব্য দিয়েছেন সে কদিনে এক সপ্তাহ পার হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা আন্দোলনকারীদের শঙ্কিত করেছে। জানা যায়, এই সময় সামরিক বাহিনীতে একটি ক্যু দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল যা বেশ কয়েকজন সিনিয়র সামরিক বাহিনীর অফিসারের শাস্তি প্রদানের ঘটনার মাধ্যমে সত্যায়িত হয়।
৬ আগস্ট আইএসপিআর-এর প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান, মেজর জেনারেল মুজিবসহ আরও দুজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত অথবা বদলি করা হয়েছে। শোনা যায় এ কজন কর্মকর্তা (এবং তাদের সঙ্গে হয়তো আরও কেউ ছিল) সেনাপ্রধানকে সামরিক শাসন জারি করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। সবাই জানেন জেনারেল জিয়া ছিল পতিত সরকারের একটা স্তম্ভের মতো। হেন অপকর্ম নেই যা তাকে দিয়ে করানো হয়নি। সহজেই অনুমেয় যে এরা সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে যে সরকার গঠিত হয়েছিল তার অপসারণের চেষ্টা করছিল। নিশ্চিতভাবেই এটা একটা প্রতি বিপ্লবী তৎপরতা।
এ মাসের ১০ তারিখ শনিবার ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী হাই কোর্ট ভবন ঘেরাও করে। পরের দিন এবং তার পরের দিন মিলে খবর আসে যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সম্ভবত চারজন বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। এ ঘটনার একদিন আগে পলাতক পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দাবি করেন যে তার মা পদত্যাগ করেননি। আইনত তিনিই এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং এ ব্যাপারে বিচার বিভাগ চূড়ান্ত রায় দেবে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় তার মায়ের এ পনেরো বছরের শাসনে রাজনীতিতে কোনো গুণগত মাত্রা যোগ করতে পারেননি আচার-আচরণ এবং উচ্চারণে তাকে অনেকের কাছেই অসংলগ্ন মনে হয়েছে। কিন্তু তার অতিকথন, বাচালতা শিক্ষার্থীদের সজাগ করে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ওই বিবেচনাহীন বিচারকরা যারা সুপ্রিম কোর্টের সর্বোচ্চ পদগুলোতে বসে আছেন তারা তো যে কোনো সময়ই এ মহান ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আবার ওই ঘৃণ্য স্বৈরাচারকে ক্ষমতায় বসানোর রায় বানাতে পারে। এটাও এক ধরনের প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা।
প্রতিবিপ্লবের এ তৎপরতা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সবশেষে তারা সওয়ার হতে চেয়েছে সংখ্যালঘুদের ওপরে। ইতোমধ্যে তারা ঢাকা ও চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদের নামে বিশাল সমাবেশ করেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। সাংবাদিকরা এসব সমাবেশ কাভার করতে গিয়ে দেখেছেন এদের মধ্যে ৯০ ভাগ লোকই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের, তাদের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগের পান্ডা। কিছু কিছু লোক নিয়ে এসেছে তারা যারা নিজেদের বাড়ির ঠিকানা ঠিকমতো বলতে পারেনি। প্রতিবেশী দেশ, দেশের কিছু কিছু নেতা, মিডিয়া এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করতে গিয়ে এমন কথাও বলেছেন যে, প্রায় এক কোটি হিন্দু এখন দেশ ছেড়ে ভারতে প্রবাসী হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
সবাই জানেন পরাজিত প্রধানমন্ত্রী এখন পলাতক। তিনি এখন প্রতিবেশী দেশে। সেখান থেকে তিনি নাকি ভিডিও পাঠিয়েছেন। সত্যি-মিথ্যা নিশ্চয়ই একদিন জানা যাবে। পতিত প্রধানমন্ত্রী সেখানে কী হালে আছেন, তৎপরতা কিংবা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন তার দায় ভারত সরকারকে নিতে হবে। কথা সত্যি প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব জনগণের সঙ্গে জনগণের হওয়ার বদলে এ যাবৎকাল কেবল সরকারের সঙ্গে সরকারের হয়ে এসেছে। পতিত সরকার প্রধানকে আশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের সরকার আবারও প্রমাণ করছে যে তারা শুধু সরকারের সঙ্গে সরকারের নয়, তাদের পছন্দের সরকারের সঙ্গেই কেবল বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখবে। বুঝতে পারি না এ পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কী করে বলেন, শেখ হাসিনার সেখানে অবস্থান ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
ইতোমধ্যে শেখ হাসিনাসহ পাঁচজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেশের একটি থানায় মামলা হয়েছে এবং সেই মামলা গ্রহণ করার জন্য ওপর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কি দুই দিন পরে কী হতে পারে তার কোনো ধারণাই করতে পারেননি?
আমরা আমাদের কথায় ফিরে আসি। যা দিয়ে শুরু করেছিলাম; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কথা। মনে রাখতে হবে এ কথাগুলো ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত এমন সময় বলছেন যার পাঁচ দিন পরে ১৫ আগস্ট। বিগত সরকারের সময় থেকে ঘোষিত জাতীয় শোক দিবস। এ দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন।
শেখ মুজিব বাংলাদেশের আকাশে এক বিষণ্ন্ন ইতিহাসের নাম। কত যে গল্প কাহিনি ছড়িয়ে আছে তার নামের ওপরে। কত যে আবেগ, ভালোবাসা মিশে আছে সেই নামের সঙ্গে। আর বিপরীতে একই সঙ্গে মিশে আছে তীক্ষè সমালোচনা, আর বলতে পারি সুতীব্র ঘৃণা। হ্যাঁ ঘৃণা।
বিশ্ব ইতিহাসে যারা শেখ মুজিবের পর্যায়ের নেতা ছিলেন তাদের অনেকের শেষ পরিণতি বড় করুণ। সেগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই নিজ নিজ দেশ তাদের নেতাদের মূল্যায়ন করেছে। এখন বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী দেশ চীন তাদের নেতা মাও সেতুং-এর মূল্যায়ন করেছে। আজীবন বিপ্লবী নেতা মাও সেতুং তার শেষ জীবনে স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ থেকে চার কুচক্রীকে সমর্থন করেছিলেন। চীনের পার্টি মাও সেতুংকে ৭০ শতাংশ বিপ্লবী আর ৩০ শতাংশ প্রতিবিপ্লবী হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে।
এ নিয়ে কোনো বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মূল্যায়নের সময় এরকম একটি বিভাজনের সুযোগ আছে। বিতর্ক সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিব গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করেছিলেন সেটা অনস্বীকার্য। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক প্রাক্কালে তাঁর গ্রেফতার হয়ে পুরো স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনুপস্থিত থাকা এবং স্বাধীনতার পরে শাসক হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা আছে। আর তাঁর জীবন ও শাসনের শেষ প্রান্তে এসে একদলীয় বাকশাল গঠন করা তাঁর সারা জীবনের গণতন্ত্র হিসেবে যে অর্জন তাকে বিসর্জন দিয়েছে। আর এজন্যই এত বড় একজন নেতার এ করুণ এবং মর্মান্তিক মৃত্যুতে জাতি শোকে মুহ্যমান হয়নি।
এবার ১৫ আগস্ট এসেছে একেবারেই এক ভিন্ন প্রেক্ষিতে, যে প্রেক্ষিত আমি একটু আগেই ব্যাখ্যা করেছি। মনে করা হচ্ছে প্রতিবিপ্লবী তৎপরতার এ অংশ হিসেবে এবার ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের নাতি শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় একটি বক্তব্য এবং কর্মসূচি দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। এবং সেই পটভূমিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তার ওই বক্তব্যটি দিয়েছেন। ১২ আগস্ট মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ইস্যুর ওপর কথা বলার জন্য ডেকেছিলেন। সেখানে এ কথাটি আমি উত্থাপন করেছিলাম। আইনবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, তারা ওই উপদেষ্টার এ ধরনের কথায় বেশখানিকটা বিব্রত। এ নিয়ে তারা আর কথা বাড়াতে চাননি। আমরাও কথা বাড়াইনি। কিন্তু কথাটা রয়ে গেছে।
সরকার ১৫ আগস্ট-এর জাতীয় ছুটি বাতিল করেছেন। সেটা নিয়ে এখন আলোচনা করছি না। কিন্তু উপদেষ্টা যেরকম করে বলেছেন সেভাবে ওদেরকে ১৫ আগস্ট পালন করতে তথা দলটিকে সংগঠিত হতে দেবেন? তিনি অবশ্য বলেছেন, নতুন নেতৃত্ব দিয়ে দল গঠন করতে। এটা কি তিনি বলতে পারেন? এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির নেতৃত্বে আছেন গত সরকারের দেওয়া সাজাপ্রাপ্ত দুজন। দলের চেয়ারপারসন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে; কিন্তু এখনো বিচার হয়নি, সাজা হয়নি। তিনি কি দলের সভাপতি থাকতে পারবেন না? অথবা ধরেন সত্যি সত্যি দল নেতৃত্ব বদল করে নতুন কাউকে দিল খুবই অস্থায়ী ভিত্তিতে। ধরুন সোহেল তাজকে। এ সরকার তাদেরকে মুক্তভাবে কাজ করতে দেবে? প্রশ্নগুলো আমি আওয়ামী লীগের হয়ে করছি না। প্রশ্নটা রাজনৈতিক এবং আরও ব্যাখ্যা করে বললে, শুরুতে আমি যে বলেছিলাম স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণে কী পথ আপনি নেবেন সেই দিক থেকে।
ডক্টর ইউনূসও গতকাল ১৩ আগস্ট এক আলাপচারিতায় বলেছেন, গোটা দেশকে একটা পরিবারের মতো গড়ে তুলতে হবে। উনি আশাবাদী- তাহলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব। সেই পরিবারে কারা থাকবে? সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং তার জোট সঙ্গীরা থাকবে?
স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের কারণে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। দীর্ঘ বছর তাদেরকে মুক্তভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতেও দেওয়া হয়নি। কিন্তু এখন জামায়াতে ইসলামীর নাম ক্ষমতার চেয়ার থেকে সর্বাগ্রে উচ্চারিত। এবং এতগুলো বছর পরেও জামায়াতে ইসলামী একটি শক্তিশালী দল। শুধু নিষেধাজ্ঞা এবং বিধান করে তাদেরকে রাখা যায়নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর মতো রেজিমেন্টের দল নয়। তারা আর আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না সেই প্রশ্ন করাই যায়; কিন্তু আমি দল দিয়ে বিচার করছি না। ভাবছি স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের নীতি পদ্ধতি নিয়ে।
লেখক : ডাকসুর সাবেক ভিপি, নাগরিক ঐক্য