ইসলামে ঘুষ-দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতিবাজরা শাসক হোক আর সাধারণ কর্মচারী হোক সবার জন্যই তা অবৈধ। ইসলামের দৃষ্টিতে সব ধরনের দুর্নীতিই অন্যায়। আখিরাতে দুর্নীতিবাজদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। হাদিসে মহানবী (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণের পর খেয়ানত অবস্থায় মারা গেলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। (বুখারি : ৭১৫১)। অন্য হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, যার প্রতি আল্লাহ কোনো দায়িত্ব অর্পণ করেন, এরপর সে সুষ্ঠুভাবে তা পালন করে না, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। (বুখারি : ৭১৫০)। হাদিস শরিফে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঘুষ যে দেয় এবং নেয়, দুজনেই জাহান্নামি।’ আরেকটি হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, এমন একটা সময় আসবে যখন মানুষ ঘুষ দেওয়া-নেওয়াকে সামাজিক নিয়ম বানিয়ে ফেলবে। অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘মানুষ ঘুষ দেবে-নেবে উপহারের নামে।’ (মিশকাত শরিফ)।
ঘুষ হলো কোনো কাজ করার জন্য কর্তৃপক্ষকে আর্থিক কিংবা যে কোনো ধরনের সুবিধা দেওয়া। আমাদের নবীজি (সা.) ঘুষদাতা-গ্রহীতা দুজনকেই জাহান্নামি বলেছেন। বাংলাদেশের আইনেও ঘুষ দেওয়া-নেওয়া দুটোই দণ্ডনীয়। অথচ ঘুষই এদেশের প্রশাসনে সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য অপরাধ হয়ে উঠেছে। সব সরকারই কিছু না কিছু দুর্নীতি রোধে সফল হয়েছেন।
হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) ওমর (রা.) এর স্ত্রীকে একটি দামি পোশাক উপহার পাঠিয়েছেন। কারণ, ওমর (রা.) রাষ্ট্রপ্রধান তিনি অবশ্যই উপহার নেবেন না। কিন্তু তাঁর পরিবারের জন্য তো উপহার নিতে নিষেধ নেই। কিন্তু ওমর (রা.) এ কাপড়টিও ফেরত পাঠালেন এবং আবু মুসা আশআরিকে কঠোর হুঁশিয়ারি করে দিলেন। ওমর (রা.) খুব ভালো করেই জানতেন, শাসককে উপহার দেওয়ার পেছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য অবশ্যই থাকে। তিনি যদি পরিবারের জন্যও উপহার নেওয়ার অনুমতি দিতেন তবে অন্য প্রশাসকদের জন্য এটা অনুকরণীয় হয়ে যেত। পরকালে দুর্নীতিবাজদের কী শাস্তি হবে- এ সম্পর্কে কোরআন-হাদিসে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। দুর্নীতি করে যে যা অর্জন করবে, কিয়ামতের দিন তা নিয়েই তাদের উঠানো হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, কোনো নবীর জন্য সম্ভব নয় যে তিনি খেয়ানত করবেন। আর যে ব্যক্তি খেয়ানত করবে, সে কিয়ামতের দিন সেই খেয়ানত করা বস্তু নিয়ে উপস্থিত হবে। এরপর প্রত্যেকেই যা অর্জন করেছে তা পরিপূর্ণভাবে পাবে। আর তাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না। (সুরা আল ইমরান : ১৬১)। আবু হুমায়দ সাঈদ (রা.) বলেন, নবী (সা.) আজদ গোত্রের ইবনে উতবিয়া নামের এক ব্যক্তিকে জাকাত সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ফিরে এসে বললেন, এগুলো আপনাদের, আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে তার বাবার ঘরে কিংবা তার মায়ের ঘরে কেন বসে থাকল না। তখন সে দেখতে পেত, তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি না। যার হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম, সদকার মাল থেকে স্বল্প পরিমাণও যে আত্মসাৎ করবে, সে তা কাঁধে করে কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে। সেটা উট হলে তার আওয়াজ করবে, আর গাভী হলে হাম্বা হাম্বা করবে আর বকরি হলে ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। (বুখারি : ২৫৯৭)। দুর্নীতির মাধ্যমে অন্যায়ভাবে সম্পদ উপার্জন করা ইসলামে ভয়ংকর অপরাধ। যারা দুনিয়ায় এগুলোর সঙ্গে জড়িত হবে তাদের হাশরের ময়দানে সবার সামনে এসব অভিধায় পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। রসুল (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য একেকটি পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং বলা হবে, এটা অমুকের পুত্র অমুকের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। (বুখারি : ৬১৭৮)। স্বনামখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুুল কালাম তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেন- পৃথিবীর সব বাবার মতোই আমার বাবাও সন্তানপ্রেমিক ছিলেন। তিনি শাসন করতেন কিন্তু ভয়াবহ রকম রাগ করতে কখনোই দেখা যায়নি। একবার বাবা গ্রামের পঞ্চায়েত-প্রধান নির্বাচিত হন। পরদিন কেউ একজন এসে বাবাকে একটি উপহার দিয়ে যায়। বাবা বাসায় না থাকায় আমিই উপহারটি গ্রহণ করি। বাবা এলে আমি আনন্দের সঙ্গে উপহারের কথা বলি। বিনা আভাসেই যেন তুফান শুরু হয়ে গেল। এমন ভয়ংকর রাগ করতে বাবাকে আমি আগে-পরে আর কখনো দেখিনি। বাবা বললেন, এত দিন কেন ওরা আমাকে উপহার দেয়নি? আজ দায়িত্ব পেয়েছি আর উপহার নিয়ে এসেছে। এটা ঘুষ ছাড়া আর অন্য কী? আর তুমিইবা কোন বুদ্ধিতে এ উপহার নিয়ে নিলে? এরপর আর কখনোই এমনটি করবে না। আবদুল কালাম লিখেন- বাবার এ আচরণ আমার মনে এমনভাবে গেঁথে যায়, ঘুষ তো দূরের কথা অন্যসব অপরাধ আমার সামনে এলেই আমি আঁতকে উঠতাম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঘুষ নামের অপরাধ থেকে দূরে থাকার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ