নিত্যপণ্যের বেসামাল দামে দিশাহারা মানুষ। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের দুবেলা দুমুঠো ডাল-ভাত জোটানোই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে যাওয়া এক ধরনের আতঙ্ক মনে করছেন তারা। বাজারের এই ঊর্ধ্বমুখী লাগাম এখনই টেনে না ধরলে মানুষের বাঁচার আর কোনো পথ থাকবে না। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অবৈধ মজুতদারির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার কারণেই আজ মানুষের এত কষ্ট। পাশাপাশি দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের অপতৎপরতা এবং নামে-বেনামে চাঁদাবাজিও ভোগাচ্ছে সাধারণ জনগণকে। তবে ব্যবসা ও বাজার পরিচালনার জন্য ইসলাম এমন কিছু কল্যাণকর নীতিমালা দিয়েছে, যেগুলো মেনে চললে স্বস্তি ফিরে আসবে বাজারে। বেঁচে যাবে খেটে খাওয়া মানুষ ও মধ্যবিত্ত সমাজ।
ইসলাম ব্যবসাবাণিজ্যে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অত্যধিক লাভ করার প্রবণতা হারাম করেছে। দুনিয়া ও আখেরাতে মজুতদারির ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যারা স্বর্ণ-রুপা তথা ধন-সম্পদ জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের যন্ত্রণাদায়ক আজাবের সংবাদ দিন। সেদিন এসব ধন-সম্পদ আগুনে গরম করা হবে। তারপর তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেওয়া হবে। বলা হবে, তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলো সেসব ধন-সম্পদ। এখন মজা বুঝ।’ (সুরা তাওবা, আয়াত ৩৪-৩৫)।
সিন্ডিকেট বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অযৌক্তিক লাভের আশায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মজুত করে আল্লাহর বান্দাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা ভয়ংকর গুনাহ। প্রিয় নবীজি (সা.) পণ্য মজুত করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুত রাখে, আল্লাহতায়ালা তার ওপর দরিদ্র চাপিয়ে দেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর-৫৫)। রসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘শুধু পাপী ব্যক্তিই মজুতদারি করে থাকে।’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর-১৬০৫) মজুতদারকে অসৎ-দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দুর্নীতিপরায়ণ ছাড়া কেউ মজুতদারি করে না।’ (তিরমিজি, হাদিস নম্বর-১২৬৭)। অন্য হাদিসে নবীজি বলেন, ‘যে লোক চল্লিশ দিন খাদ্যশস্য মজুত করে রাখল, তার সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই। (মুসনাদে আহমাদ)।
সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভেঙে দিতে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘বাজারের বাইরে গিয়ে কেনাবেচা করার জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা করবে না। পশুর স্তনে দুধ জমিয়ে রাখবে না। আর দালালি কিংবা অপকৌশল করে পণ্যের দাম বাড়াবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস নম্বর-১২৬৮) হজরত ওমর (রা.) খলিফা থাকাকালীন ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুত না করে। যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে তারা যেন বাইরে থেকে খাদ্যশস্য কিনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির উদ্দেশে গুদামজাত না করে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের জনপদে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে সে ওমরের মেহমান। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক) এসব হাদিস বিশ্লেষণ করে বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইবনে হাজর হাইতামি (রহ.) ফতোয়া দিয়েছেন, ‘গুদামজাত করে মূল্য বৃদ্ধি করা হারাম।’ (নিহায়াতুল মুহতাজ, তৃতীয় খন্ড, ৪৫৬ পৃষ্ঠা)
রসুল (সা.) শুধু গুনাহর ভয় দেখিয়েই বসে থাকেননি। তিনি নিয়মিত বাজার পরিদর্শনে যেতেন। কোনো অসংগতি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘এক দিন রসুল (সা.) স্তূপ করে রাখা খাদ্যশস্যের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি স্তূপের ভিতর হাত ঢোকালে আঙুলগুলো ভিজে গেল। স্তূপের মালিককে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী? মালিক জবাব দিল, হে আল্লাহর রসুল! বৃষ্টির পানিতে তা ভিজে গিয়েছিল। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তবে তা ওপরে রাখলে না কেন, যেন মানুষ তা দেখতে পায়? যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর-১০১)।
রসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় বনু কায়নুকা গোত্রে বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে বাজারে কোনো ধরনের প্রতারণা, ঠকবাজি, ওজনে কম দেওয়া বা পণ্যদ্রব্য মজুত করে মূল্য বৃদ্ধি করে জনগণকে কষ্ট দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ওলামারা বলেন, ‘সরকারের কর্তব্য হলো অস্থিতিশীল বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। ব্যবসায়ীরা যদি অতিরিক্ত মূল্য নেয় এবং বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তখন জনগণের ভোগান্তি কমানোর জন্য সরকার পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেবে, যতক্ষণ না বাজার স্বাভাবিক হয়।’ (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, প্রথম খন্ড, ৩১৩ পৃষ্ঠা)। হানাফি মাজহাবের প্রখ্যাত আলেম ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) বলেন, ‘নগরবাসী বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সরকার মজুতদারকে বাধ্য করবে, যেন সে তার পণ্য সাধারণ মূল্যে বা যতটুকু বেশি মূল্যে মানুষ মেনে নেয়, সেই মূল্যে বিক্রি করতে।’ (ফাতাওয়া আলমগিরি, তৃতীয় খন্ড, ২১৪ পৃষ্ঠা)।
লেখক : খতিব, উঁচাবাড়ি বাইতুস সুজুদ জামে মসজিদ, পোস্তগোলা, ঢাকা