আরবি মিলাদ মানে হলো জন্ম। আর মোস্তফা হলেন নুর নবীজি (সা.)। মিলাদে মোস্তফা মানে হলো নুর নবীজির জন্ম। হাদিস শরিফ থেকে জানা যায়, হুজুর (সা.) প্রায় সময়ই নিজের জন্ম নিয়ে আলোচনা করতেন। সাহাবিরাও নবীজির শুভাগমন সম্পর্কে আলোচনা করাকে বরকতপূর্ণ মনে করতেন। জরত আবু উমামার (রা.) এক প্রশ্নের জবাবে নবীজি (সা.) নিজের মিলাদের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘তোমরা আমার জন্ম তথা আগমন সম্পর্কে জানতে চাও? তাহলে শোনো, আমি হলাম আমার পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া ও ইসমাইল (আ.)-এর সুসংবাদ। আমার জন্মের সময় আমার মা দেখেছেন তাঁর দেহ থেকে একটি নুর বের হয়ে শামের বড় দালানগুলো আলোকিত করে দিয়েছে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নম্বর ২২৩১৫, সহিহ ইবনে হাব্বান, হাদিস নম্বর ৬৪০৪)। একবার সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওগো আল্লাহর হাবিব! আপনি প্রতি সোমবার রোজা রাখেন কেন?’ জবাবে নবীজি (সা.) বললেন, ‘এদিন আমি জন্মগ্রহণ করি এবং এদিনই আমার নবুয়ত প্রকাশ হয়।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস নম্বর ২৬৪০)।
নবীজিকে যারা ভালোবাসে তারা বেশি বেশি নবীজিকে স্মরণ করে। আর নবীজিকে স্মরণের অন্যতম আজিমুশ শান পদ্ধতি হলো মিলাদে মোস্তফা বা মিলাদ মাহফিল। আজও আশেকে রসুলেরা কারণে-অকারণে সুখে-দুঃখে একত্রিত হয়ে দরুদের মজলিসের আয়োজন করেন। দরুদ ফারসি শব্দ। এর অর্থ শুভকামনা বা কল্যাণ প্রার্থনা। ইসলামের পরিভাষায় দরুদ বলতে বোঝায় ‘সালাত আলান নবী’, অর্থাৎ নবীজির (সা.) প্রতি দোয়া। যেমন নবীজির নাম উচ্চারণের সময় ‘সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর ওপর’ বলা হয়। এটি একটি দরুদ।
আল্লাহর কাছে ইবাদত-বন্দেগি গ্রহণযোগ্য করতে পরম ভক্তি ও ভালোবাসা ভরা অন্তরে নিবিষ্টভাবে নবীর (সা.) ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা উচ্চপর্যায়ের নেক আমল। দোয়া কবুলের জন্য মহানবীর ওপর দরুদ পাঠ করা অত্যন্ত জরুরি। দরুদ শরিফ পাঠ করলে আল্লাহর দরবারে ইবাদতের বিনিময় সুনিশ্চিত হয়। দরুদ পড়া এমন এক ইবাদত, যা আল্লাহ অবশ্যই কবুল করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর জন্য সালাত পাঠ করেন। হে বিশ্বাসীগণ, তোমরাও নবীর জন্য সালাত ও সালাম পাঠ করো।’ (সুরা আহজাব, আয়াত ৫৬)। এ আয়াত ছাড়াও কোরআন হাদিসের আরও অনেক জায়গায় ‘সালাত’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে সালাত শব্দটি দুটি ইবাদত বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমটি হলো- নামাজ। আর দ্বিতীয়টি হলো- নবীজির প্রতি ‘দরুদ শরিফ’ পাঠ করা। আলেমরা বলেন, ‘আল্লাহর ক্ষেত্রে সালাতের অর্থ ফেরেশতাদের সামনে নবীজির প্রশংসা করা। ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে সালাতের অর্থ দোয়া করা’। আর উম্মতদের পক্ষ থেকে সালাতের অর্থ হলো- নবীজির জন্য মাকামে মাহমুদের দোয়া।
দরুদ শরিফ পড়ার ফজিলত অনেক। এক দিন এক লোক রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে নামাজ পড়ে দোয়ার জন্য হাত তুলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহ মাফ -করো এবং আমার ওপর রহম করো!’ তখন রসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, ‘ওহে মুসল্লি! তুমি খুব তাড়াহুড়া করেছো। শোনো, যখন তুমি নামাজ পড়বে, তখন প্রথমে আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করবে, তারপর আমার ওপর দরুদ পাঠ করবে এবং সবশেষে নিজের জন্য দোয়া করবে।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)। ভক্তির সঙ্গে দরুদ শরিফ পড়লে বান্দার গুনাহ মাফ হয়। দরুদ পাঠের অশেষ সওয়াব সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর মাত্র একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর ১০ বার রহমত নাজিল করেন এবং কমপক্ষে তার ১০টি গুনাহ মাফ করেন। তার আমলনামায় ১০টি সওয়াব লেখা হয় এবং আল্লাহর দরবারে তার মর্যাদা ১০ গুণ বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়।’ (নাসায়ি)। রসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তির নাক মাটিতে মিশে যাক, যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হয় অথচ সে আমার ওপর দরুদ পড়ে না।’ (তিরমিজি)। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে, যে ব্যক্তি আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পড়ে।’ (তিরমিজি)।
হাদিস শরিফে আরও মজার বর্ণনা এসেছে। যারা নবীজির ওপর দরুদ শরিফ পড়ে তাদের দরুদ নবীজির কাছে পৌঁছানো হয়। আউস ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘তামাদের দিনগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম দিন হচ্ছে জুমার দিন। ওই দিন তোমরা আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পড়। কেননা, তোমাদের দরুদ আমার কাছে পেশ করা হয়।’ লোকেরা বলল, ‘ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনার তো তখন ওফাত হয়ে যাবে, আমাদের দরুদ কীভাবে আপনার কাছে পেশ করা হবে?’ জবাবে হুজুর (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ পয়গম্বরদের দেহগুলোকে খেয়ে ফেলা মাটির ওপর হারাম করে দিয়েছেন।’ (আবু দাউদ)।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক