স্যান মার্কোস স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আমার জামাতা সালমান বিন হাবিব। ওর ইচ্ছা ছিল নিজের বিশ্ববিদ্যালয়টা আমাকে দেখানোর। স্বাভাবিকভাবেই আমারও প্রবল ইচ্ছা হলো। দিন কয়েক আগে টানা চার ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমরা গেলাম স্যান মার্কোস। পথে বাকিজ গ্যাস স্টেশনে নেমে সামান্যক্ষণ থেকে ফুয়েল নেওয়া, কিছু খাওয়া আর টুকিটাকি কেনাকাটা। ইউনিভার্সিটিটা খুবই সুসজ্জিত। পাহাড়ি এলাকা। গাছপালায় ছাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি মনোরম বললে কম বলা হবে। আসলে ঠিক ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। ওপর থেকে দেখলে মনে হয় চাঁদ থেকে পৃথিবী দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণনা অন্য সময় দেব। আজ বলি এলবিজের কথা। ওখানে যাওয়ার পর থেকেই সালমান বলছিল, ‘আর কারও সঙ্গে দেখা হোক না হোক এলবিজের সঙ্গে দেখা করতে হবে।’ এলবিজেকে আমি জানতাম জন এফ কেনেডি সূত্রে। কেনেডির মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন তাঁর গাড়িবহরের মাত্র দুই-তিনটি গাড়ি পরে। তখন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট। কেনেডির মৃত্যুর পর তাঁকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে হয়। জেএফকে মারা গিয়েছিলেন মানে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল টেক্সাসের ডালাসে। ডিলে প্লাজার পাশে রাস্তায়। সেই রাস্তায় আমি গিয়েছি। দেখেছি জেএফকে মেমোরিয়াল। তখনই জেনেছি এলবিজের কথা।
স্যান মার্কোস ইউনিভার্সিটিতে অসংখ্য স্ট্যাচু ছড়ানো। তার সবই কোনো না কোনো প্রতীক। তবে একজন মানুষেরই স্ট্যাচু আছে, তিনি এলবিজে। আছে এলবিজে স্টুডেন্ট সেন্টার, অজস্র স্মৃতিচিহ্ন, বাণী, তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি, এমনকি তাঁর লেখা নোট ও বক্তৃতার রেকর্ড। শিক্ষার্থীদের মাঝে তাঁকে ছড়িয়ে দেওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা নিয়েছে এ ইউনিভার্সিটি। যেন তিনি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকেন। সালমান বলছিল, ‘টেক্সাসবাসী এলবিজেকে নিয়ে খুব গর্ব করে। আরও বেশি গর্ব করে এ কলেজ। কারণ, তিনি এ কলেজের ছাত্র।’ গর্ব করারই কথা। আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্যে ৫০ জনও প্রেসিডেন্ট নেই। তার মধ্যে একজন এলবিজে। তিনিই টেক্সাস থেকে একমাত্র প্রেসিডেন্ট। তিনি আমেরিকার ৩৬তম প্রেসিডেন্ট। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম এলবিজের স্ট্যাচুর সামনে। একটা চত্বরের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তিনি হাত বাড়িয়ে। উঠলাম, হাত মেলালাম। অভূতপূর্ব অনুভূতি হলো! মাত্র কদিন আগে হাত মিলিয়েছি হুইলচেয়ারে বসা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সঙ্গে।
লিন্ডন বি. জনসন আমেরিকার ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নাম। তিনি শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নন, একজন সংগ্রামী ছাত্র, শিক্ষক হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে আছেন। স্মরণীয় সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে। আমেরিকার অধিকাংশ প্রেসিডেন্ট ধনী বংশজাত। নিজেরাও ধনী। ব্যবসাপত্র টাকাপয়সা সবই তাঁদের ছিল। এ ক্ষেত্রে এলবিজে ব্যতিক্রম। টেক্সাসের মাটিতেই তাঁর শিকড়। তাঁর জন্ম ১৯০৮ সালের ২৭ আগস্ট, টেক্সাসের ছোট্ট শহর স্টোনওয়ালে। পিতা ছিলেন শিক্ষক। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। কিন্তু জনসনের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। পরিবারের আর্থিক অবস্থা তাঁর সেই স্বপ্নের বিশালত্বে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও তাঁকে দমাতে পারেনি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন নিজে শিক্ষিত হয়ে দেশের নেতৃত্ব দেবেন, দেশের জন্য কিছু করবেন। ১৯২৭ সালে তিনি স্যান মার্কোস স্টেট কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজটিই এখন স্যান মার্কোস স্টেট ইউনিভার্সিটি। এ কলেজ তাঁর জীবনে আনে বিশাল পরিবর্তন। এখানেই ব্যাপ্তি ঘটে এলবিজের ব্যক্তিত্বের আর জড়িত হয়ে পড়েন রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে। আর কালে কালে তিনি হয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ক।
এলবিজের পরিবারে দারিদ্র্য ছিল। টিউশন ফি ও দৈনন্দিন খরচের সংকুলান করার জন্য তাঁকে বিভিন্ন কাজ করতে হতো। কখনো ক্যাম্পাসে জানালা মুছতেন, কখনো সহকারী কুক হিসেবে কাজ করতেন। এসব কাজ করতে করতেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি শ্রমজীবী মানুষকে ভালোবেসে ফেলেন, সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন তাদের প্রতি। এলবিজে যে সময় ছাত্র ছিলেন তখন কলেজে জাতিগত বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য ছিল মারাত্মক। পদে পদে এসব বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হতো। এলবিজের মনে তখন থেকেই এই অসাম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমতে থাকে। তিনি সব রকম বৈষম্যবিরোধী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর আনা নীতিগুলোতে প্রকাশ পায় এ মনোভাব। স্নাতক হওয়ার পর তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। চাকরি নেন টেক্সাসের এক মেক্সিকান-আমেরিকান অধ্যুষিত এলাকায়। এখানে শিক্ষকতা করতে গিয়েই তিনি একেবারে সরাসরি বুঝতে পারেন কীভাবে জাতিগত বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং অশিক্ষা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি থাকলে আর একটি থাকেই। একটি অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। আজীবন তিনি ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন। এ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে। স্যান মার্কোস স্টেট কলেজ ছিল তাঁর শিক্ষা, রাজনৈতিক ও নৈতিক চেতনার বীজতলা। এখানে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি বক্তৃতা দিতে শেখেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস ও সংবিধান বিষয়ে নিবিড়ভাবে পাঠ নেন। স্যান মার্কোস ইউনিভার্সিটি একজন সাধারণ ছাত্রকে নেতৃত্বের উচ্চশিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। আবার এ কথাও সত্য, ওই প্রতিষ্ঠানে তো কত ছাত্রই ছিল, তারা কেউ এলবিজে হয়নি। যোগ্যতা ছিল বলেই তিনি পেরেছেন। জনসনের জীবন আত্মোন্নয়নের এক অনুপম উদাহরণ। এল বি. জনসন ১৯৬৩-১৯৬৯ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রজ্ঞাবান। তবে ইতিহাসে তাঁকে নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। জনসনের রাজনৈতিক দর্শন ও সিদ্ধান্তগুলো আমেরিকার সমাজ, অর্থনীতি ও বৈদেশিক নীতিতে বিশাল পরিবর্তন আনে। যা আজও বহমান। ১৯৩৭ সাল। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হন। এরপর আর তাঁকে থামতে হয়নি। সিনেটর হন, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য হিসেবে এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি। জনসনের অবিচ্ছেদ্য সহযাত্রী ছিলেন ক্লাউডিয়া অল্টা ‘লেডি বার্ড’ জনসন। তিনি একাধারে তাঁর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি শুধু প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন একজন সমাজসেবী, পরিবেশবাদী এবং শিক্ষাবান্ধব নারী।
লেডি বার্ড জনসন ১৯১২ সালে টেক্সাসে জন্মগ্রহণ করেন। সেই রক্ষণশীল সমাজে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস এবং সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি জনসনের পরামর্শদাতা ও আর্থিক সহায়ক হিসেবেও ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৪০-এর দশকে কংগ্রেস নির্বাচনে লিন্ডনের প্রচারাভিযানে নিজেই রেডিও স্টেশন কিনে তাঁর প্রচারের জন্য ব্যবহার করেন। এ ছাড়াও পরিবেশ রক্ষায় তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান ‘হাইওয়ে বিউটিফিকেশন অ্যাক্ট’ (১৯৬৫)। এই অ্যাক্টের মাধ্যমে তিনি আমেরিকার সড়কপথগুলো সুন্দর, পরিষ্কার ও সবুজ রাখার জন্য আইনগত পদক্ষেপ নেন। সড়কের দুপাশে ফুলের বীজ ছড়ান। এ কারণে অনেকেই তাঁকে ‘পরিবেশসচেতনতায় প্রথম ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে অভিহিত করেন। ১৯৬০ সালে জনসন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন জন এফ কেনেডির সহচর। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকাণ্ডের পর দৃশ্যপট বদলে যায়। আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। অনেক বড় বড় সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন এলবিজে। তার মধ্যে রয়েছে গ্রেট সোসাইটি। এটি একটি সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ এবং শিক্ষা উন্নয়ন। মেডিকেয়ার মেডিএইড সংস্কার কার্যক্রম চালু করেছিলেন প্রবীণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে। ইতিহাসবিদরা তাঁর ‘গ্রেট সোসাইটি’ প্রোগ্রামকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম যুগান্তকারী সমাজকল্যাণ পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করেন। সিভিল রাইটস অ্যাক্ট ১৯৬৪ তাঁর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি ছিল বর্ণবৈষম্য অবসান করে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার আইন। (ভোটিং রাইটস অ্যাক্ট অব ১৯৬৫) ভোটাধিকারে বৈষম্য নিরসনের জন্য ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এডুকেশন রিফর্ম সরকারি অর্থায়নে বিদ্যালয় ও কলেজগুলোর উন্নয়ন। ওয়ার অন পোভার্টি কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। লাখ লাখ মানুষ এ কর্মসূটির মাধ্যমে সহায়তা পেয়েছিল। এ সমাজ সংস্কার চিন্তার বীজতলা ছিল স্যান মার্কোস। জনসনের সময়কালে আমেরিকার ইতিহাসের বড় বড় নাগরিক অধিকার আন্দোলনগুলো ঘটে। তিনি দক্ষিণাঞ্চলের বিরোধিতার মুখেও বর্ণবৈষম্য বিলুপ্তির পক্ষে কাজ করেছিলেন। ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে যে আইনগুলো প্রণীত হয়েছিল তা আফ্রিকান-আমেরিকানদের সামাজিক ন্যায়প্রাপ্তি ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছিল। এটা ছিল অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ, যা জনসন সাহস নিয়ে করেছিলেন। জনসন ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় সংকল্প ও কৌশলী। তিনি ছিলেন একজন যথার্থ নেতা। কংগ্রেসে দীর্ঘদিন কাজ করায় আইন প্রণয়নের কলাকৌশল ভালোই রপ্ত করেছিলেন। তিনি জানতেন কোথায় চাপ দিতে হয় আর কোথায় সমঝোতা করতে হয়। অনেকে তাঁর এ কৌশকে বলতেন জনসন ট্রিটমেন্ট।
ঘরোয়া নীতিতে অসামান্য সফলতা পেয়েছিলেন এলবিজে, কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ তাঁর প্রশাসনের ব্যর্থতা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল। তিনি শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু কথা রাখতে পারেননি। ভিয়েতনামে মার্কিন সেনা উপস্থিতি বাড়াতে থাকেন। দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধ জনগণের কাছে গ্রহণীয় ছিল না। ফলে তিনিও দ্রুত অজনপ্রিয় হতে থাকেন। ফলে ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাঁকে। লিন্ডন বি জনসনের সামাজিক সংস্কার নীতিগুলো আধুনিক আমেরিকার ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ তাঁর ভাবমূর্তিকে ম্লান করেছিল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সমানাধিকারের সমাজে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ইতিহাসে রয়ে গেছেন সেই নেতা হিসেবে, যিনি আমেরিকার গরিব, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। তাই আমেরিকার সাধারণ, দরিদ্র ও দলিত জনগোষ্ঠীর কাছে তিন পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার।
লেখক : কথাশিল্পী ও গবেষক