শনিবার, ১৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

অকালে হারিয়ে যাওয়া সেই জাফর ইকবাল

অকালে হারিয়ে যাওয়া সেই জাফর ইকবাল

জাফর ইকবাল মানে কালজয়ী এক গায়ক আর অভিনেতার প্রিয় মুখ। তার গাওয়া গান ও অভিনীত চলচ্চিত্রের সুবাদে ভক্তদের হৃদয়ে এখনো ভালোবাসায় চির ভাস্বর হয়ে আছেন তিনি। চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন ক্ষণজন্মা এই তারকা। তাকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

গাইতে গিয়ে নায়ক...

নিজের ব্যান্ড নিয়ে কনসার্টে গাইতে গিয়ে নজরে পড়েন জাফর ইকবাল। ১৯৬৯ সালের কথা। একটি গানের অনুষ্ঠানে মঞ্চে তাকে দেখে দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ খান আতাউর রহমান মুগ্ধ হন। এরপর ১৯৭০ সালে তার পরিচালিত ‘আপন পর’ ছবির মাধ্যমে নায়ক হিসেবে পর্দায় অভিষেক ঘটে জাফর ইকবালের। এ চলচ্চিত্রের একটি সুপার-ডুপার হিট গান চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে জাফর ইকবালকে নিয়ে যায় অন্য মাত্রায়। ‘আপন পর’-এ প্রয়াত সংগীতশিল্পী বশির আহমেদের কণ্ঠে ‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি/যা কিছু বলার ছিল বলে দিয়েছি’ গানটি এখনো শ্রোতাপ্রিয়।

 

তার আদর্শ এলভিস প্রিসলি...

গিটার বাজাতেন ভালো। তার আদর্শ তারকা ছিলেন রক এন রোলের রাজা এলভিস প্রিসলি। আশির দশকে ছিলেন দাপুটে নায়ক। তার সময়ের সবচেয়ে ফ্যাশন সচেতন ও স্টাইলিস্ট অভিনেতা। অথচ চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবালের জন্ম সুরের ভুবনে। গায়কই হওয়ার কথা ছিল তার। ব্যান্ড ছিল তার। অ্যালবামও আছে। রুপালি পর্দায় বিচরণের আগে গিটারবাদক ছিলেন জাফর ইকবাল।

ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা তিনি...

গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ১৯৬৭ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুককে নিয়ে জাফর ইকবাল গঠন করেছিলেন র‌্যাম্বলিং স্টোনস নামের ব্যান্ড। সেই সময়ে ব্যান্ড নিয়ে দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ১৯৬৮ সালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। প্রতি শনি ও রবিবার ওই হোটেলে সংগীত পরিবেশন করত তার ব্যান্ডটি।

 

গান না শিখেই গায়ক...

তার সাংস্কৃতিক যাত্রা শুরু গান দিয়ে। তবে তিনি কারও কাছে গান শেখেননি। সুরের ভুবনে বেড়ে ওঠায় গান না শিখেও খুব ভালো গাইতে পারতেন। বড় ভাই অমর সুরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ ও ছোট বোন কিংবদন্তি গায়িকা শাহনাজ রহমতউল্লাহর দেখাদেখি নিজেও গাওয়ার চেষ্টা করতেন। ভাইবোনের মতো গানটাকে ভালোবাসতে শেখেন, গাইতে শুরু করেন। গিটার বাজানোতে আলাদা দক্ষতা ছিল জাফর ইকবালের। এসএসসি পাস করার আগেই গিটার বাজানোয় দক্ষ হয়ে ওঠেন। এলভিস প্রিসলি ছিল তার প্রিয় শিল্পী। স্কুলে কোনো অনুষ্ঠান থাকলেই গিটার বাজিয়ে এলভিস প্রিসলির গান গাইতেন তিনি। সাংগীতিক আবহে বেড়ে ওঠা জাফর ইকবালের আবির্ভাব সংগীতশিল্পী হিসেবে। সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে গিটার বাজাতেন। ইন্দিরা রোডের স্টুডিওতে রবিন ঘোষের সুরে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের ‘পিচ ঢালা পথ’ ছবির ‘পিচঢালা এই পথটাকে ভালোবেসেছি’ গানে গিটার বাজান তিনি। কালজয়ী এই গানের গিটারের পিস তারই বাজানো। এ ছাড়া অনেক ছবির আবহসংগীত করেছেন তিনি। নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত ‘বদনাম’ ছবিতে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও, আমি তো এখন আর নই কারও’ গানটিও তার গাওয়া। নিজের পরিচালনায় এই গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক। দারাশিকো পরিচালিত ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি আলাউদ্দিন আলীর সুর ও সংগীত পরিচালনায় রুনা লায়লার সঙ্গে ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে পুড়ে’ গানে কণ্ঠ দেন জাফর ইকবাল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ছবিতে ‘জয় আবাহনী, জয় মোহামেডান’ গানে কণ্ঠ দিয়ে মোহামেডানের পক্ষ নেন তিনি।

 

বিটিভির সংগীতশিল্পী...

বিটিভির ‘আনন্দমেলা’য় বেশ কয়েকটি গান গেয়েছেন। আশির দশকের মাঝামাঝি নিজের গাওয়া গানগুলো নিয়ে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ নামে একটি একক অ্যালবাম বের করেন তিনি।  বিটিভিতে জাফর ইকবাল পরিবেশন করেন ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী, হয়ে কারও ঘরনী’। বিটিভির রজতজয়ন্তী উদযাপনের অনুষ্ঠানে জাফর ইকবাল গেয়েছিলেন ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কী আছে’। জাফর ইকবালের অনবদ্য গানের তালিকায় আরও আছে ‘যেভাবেই বাঁচি, বেঁচে তো আছি, জীবন আর মরণের কাছাকাছি’, ‘শেষ করো না, শুরুতেই খেলা, না ভেঙো না’, ‘বিদেশ থেকে দেশে আইলে’। তিনি প্রায় ২০০ গান গেয়েছেন।

ফ্যাশন আইকন...

কণ্ঠ, অভিনয়, ফ্যাশন ও স্টাইল মিলিয়ে জাফর ইকবাল ছিলেন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী। আশির দশকে তরুণদের ফ্যাশন আইকন ভাবা হতো তাকে। একজন অনবদ্য অভিনেতার পাশাপাশি গায়ক ও স্টাইলিশ মানুষ হিসেবে বিস্তৃত তার শিল্পীসত্তার পরিধি। নায়ক-গায়ক জাফর ইকবাল যেন এক চিরসবুজের প্রতীক। ওই সময়ের নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে ফ্যাশনেবল ও স্টাইলিশ ছিলেন এই হার্টথ্রব নায়ক। তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে তার জনপ্রিয়তার পাল্লা ছিল ভারী। তার কথা বলা, হাঁটা, গিটার বাজানো সবই সব বয়সের মানুষের নজর কেড়েছিল।

 

মুক্তিযোদ্ধা...

জাফর ইকবাল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে তিনি যেমন পাকিস্তানি হানাদারদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের শোবিজে অভিনয়, গান আর স্টাইল জাদুতে আবিষ্ট করেছেন গুণমুগ্ধদের। যে মোহাবিষ্টতা এখনো ছাড়াতে পাড়েনি তার ভক্তরা। বরং তা প্রবাহিত হয়েছে নতুন প্রজন্মের কাছে। ক্ষণজন্মা এই তারকা গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে।

 

প্রেমের গুঞ্জন...

পর্দার সফল জুটি জাফর ইকবাল ও ববিতার প্রেমের গুঞ্জন উঠেছিল। তারা একসঙ্গে প্রায় ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেন। ববিতার জবানীতে জানা যায়, জাফর ইকবালের পুরো ঘরভর্তি তার ছবি সাঁটা ছিল। তিনি কাউকে রুমে ঢুকতে দিতেন না। কেবল ববিতাকেই সে রুমে ঢুকতে দিয়েছিলেন। কথিত আছে, প্রেম ভেঙে যাওয়ায় জাফর ইকবাল অতিরিক্ত মদ্যপানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকেই বলেন, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারো ঘরণী’ গানটি জাফর ইকবাল ববিতার জন্যই গেয়েছিলেন। যদিও প্রেমের বিষয়ে ববিতা বা জাফর ইকবাল কেউ-ই কখনো মুখ খোলেননি। জাফর ইকবাল ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন চলচ্চিত্রের বাইরের মানুষ সোনিয়াকে।

 

অভিনীত চলচ্চিত্র...

জাফর ইকবালের প্রথম অভিনীত ছবি হচ্ছে ‘আপনপর’। তিনি প্রায় ১৫০টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলোÑ সাধারণ মেয়ে, একই অঙ্গে এতরূপ, ফকির মজনু শাহ, দিনের পর দিন, সূর্য সংগ্রাম, বেদ্বীন, অংশীদার, মেঘ বিজলী বাদল, সাত রাজার ধন, আশীর্বাদ, অপমান, এক মুঠো ভাত, পরিবর্তন, সিআইডি, নয়নের আলো, গৃহলক্ষ্মী, ওগো বিদেশিনী, নয়নের আলো, বন্ধু আমার, অবুঝ হৃদয়, ভাইবন্ধু, প্রেমিক, মাই লাভ, নবাব, প্রতিরোধ, ফুলের মালা, মর্যাদা, সন্ধি, আকর্ষণ, ছোবল, বেদ্বীন, মিস লঙ্কা, আদেশ, ওগো বিদেশিনী, সিআইডি, অপেক্ষা, উছিলা, অবদান, প্রতিরোধ, যোগাযোগ, অবুঝ হৃদয়, গর্জন, চোরের বউ, লক্ষ্মীর সংসার  প্রভৃতি।

 

শেষ ছবির স্মৃতি...

জাফর ইকবাল বেঁচে থাকতে তার অভিনীত শেষ ছবি হিসেবে মুক্তি পায় ‘লক্ষ্মীর সংসার’ ছবিটি। এই ছবিতে তার ঠোঁট মেলানো গান ‘আজিমপুর যাব কিভাবে’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ছবিটি মুক্তির এক সপ্তাহের মধ্যেই জাফর পরপারে চলে যান। মৃত্যুর পর জাফর ইকবালকে আর আজিমপুর খুঁজতে হয়নি। সহজেই সেখানে চলে গেলেন এবং চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লেন।

               

বিয়ে-সংসার-বিদায়...

জাফর ইকবালের স্ত্রীর নাম সোনিয়া। তাদের দুই সন্তান ছিল। চিত্র জগতের এক জনপ্রিয় নায়িকাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তাকে জীবনে না পেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তিনি। তার এই বিপর্যয়ের কারণে পারিবারিক জীবনেও শান্তি পাননি। অশান্তির কারণে জাফর ইকবাল মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়েন। মদ পান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন। পরবর্তীতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তার হার্ট এবং কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন জনপ্রিয় নায়ক জাফর ইকবাল। ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে চলে যাওয়া এই জীবন গল্পের নায়ক জাফর ইকবাল।

সর্বশেষ খবর