গাঢ় প্রণয় থেকে বিয়ে, নানা টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত মন। বলা হচ্ছে বলিউডের ট্র্যাজেডি কুইন খ্যাত ষাট ও সত্তর দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মীনা কুমারীর পোড় খাওয়া জীবনের কথা। তাঁর এমন জীবনী নিয়ে এবার বলিউডেই নির্মিত হবে চলচ্চিত্র ‘কামাল-মীনা’। সম্প্রতি এমনটাই ঘোষণা দিলেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রনির্মাতা সিদ্ধার্থ পি মালহোত্রা। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বললেন, বড় পর্দায় আসছে হিন্দি ছবি ‘কামাল-মীনা’। ষাট দশকের নায়িকা মীনা কুমারী ও পরিচালক কামাল আমরোহীর প্রেম কতটা বর্ণময় ছিল এবং কীভাবে তা বিষাদে গড়ায় সেটা তুলে ধরা হবে এ ছায়াচিত্রে। ‘কামাল-মীনা’ ছবিটির যৌথ প্রযোজনা করবে সারেগামা ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং লায়নহার্ট সিনেমা। পরিচালক জানিয়েছেন, একেবারে শুরু থেকে উভয়ের শেষ ছবি ‘পাকিজা’ পর্যন্ত ধরার ভাবনা তাঁর। ছবির শুটিং শুরু আগামী বছর। সংগীত পরিচালনায় এ আর রহমান। ২০২৬-এ রুপালি পর্দায় ছড়িয়ে পড়বে এ নায়িকা-পরিচালকের প্রেমের কাহিনি।
যেভাবে প্রেম ও বিচ্ছেদ
সময়টা পঞ্চাশ-ষাটের দশক। বিনোদন দুনিয়ায় কাজ করতে এসে ১৮ বছরের মেয়েটি প্রেমে পড়েছিলেন ৩৪ বছরের পরিচালকের। মীনা কুমারী-কামাল আমরোহী। সেই প্রেম ২০ বছর ধরে নানা রঙে রঙিন। সময়ের প্রলেপে ধূসর হওয়ার বদলে যেন আরও রঙিন। ‘চলতে চলতে ইউহিঁ কোয়ি মিল গ্যয়া থা’ গানের মতোই মীনার জীবনে আচমকা উপস্থিত কামাল। প্রেম গাঢ় হতেই বিয়ে। নানা টানাপোড়েনে শেষদিকে ক্ষতবিক্ষত মন। কিন্তু কেউ কাউকে ভুলতে পারেননি।
বিষাদময় স্বল্প জীবন
‘ইনি লোগোনে লে লিয়া দোপাট্টা মেরা’... কিংবা ‘চলতে চলতে কই মুঝে মিল গিয়া’র মতো গানগুলো বলিউড কিংবদন্তি অভিনেত্রী মীনা কুমারীর কষ্টমাখা জীবনের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে যথেষ্ট। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিবারকে বাঁচাতে চলচ্চিত্রে আসা, বারবার প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, অন্যের স্বার্থের বলি হওয়া, তীব্র মনঃকষ্টে শরীরে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বাঁধা এবং মাত্র ৩৯ বছরের জীবন অবসান হওয়া ছিল বলিউডের ট্র্যাজেডি কুইন খ্যাত মীনা কুমারীর বিষাদময় জীবনের গল্প।
ট্র্যাজেডির সেই দুঃখগাথা গল্প
ব্যক্তিগত জীবনে নানা সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি মীনা। তাঁর জীবনে সুযোগ সন্ধানী পুরুষের অভাব ছিল না। কিন্তু তিনি যেমন প্রেম চেয়েছিলেন তেমন হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা তাঁকে কেউ উপহার দিতে পারেনি। ১৯৫২ সালে তিন সন্তানের জনক বিবাহিত কামাল আমরোহীর প্রেমে পড়েন মীনা এবং সে বছরই বিয়ে হয় তাঁদের। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে কোনো সন্তান হোক তা চাননি কামাল এবং ভালোবাসার জন্য নয়, উঠতি নায়িকা মীনাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন নিত্যনতুন সিনেমা বানাবেন বলে। ক্যারিয়ারে সাফল্যের শিখরে পৌঁছালেও দাম্পত্যজীবনে কামাল আমরোহীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। স্বামীর কাছ থেকে যে ভালোবাসা চেয়েছিলেন তা পাননি বলে মীনা কুমারীর মনে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। ১৯৫৬ সালে কামাল আমরোহী মীনা কুমারীকে প্রধান চরিত্রে রেখে ‘পাকিজা’ নামের একটি সিনেমার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ১৯৬৪ সালে মীনা-আমরোহীর দাম্পত্যে চিড় ধরে। তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এ সময় মীনা কুমারী হতাশা থেকে মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। সেই সঙ্গে তাঁর জীবনে নিত্যনতুন পুরুষের আনাগোনা শুরু হয়। জীবনের এ পর্বেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে অভিনেতা ধর্মেন্দ্রের। তাঁর স্ত্রী প্রকাশ কউর থাকতেন পাঞ্জাবে। ধর্মেন্দ্রর প্রথম ছবিটি ব্যর্থ হওয়ায় চলচ্চিত্রে তাঁর কোনো আশা-ভরসাই নেই তখন। এ সময় মীনা কুমারীর নজরে পড়েন তিনি। দুজনে একসঙ্গে অভিনয় করেন ‘পূর্ণিমা’ সিনেমায়। মীনা কুমারী এ অনভিজ্ঞ তরুণকে অভিনয় শেখানো শুরু করেন এবং প্রায় হাতে ধরেই তাঁকে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর জীবনে ধর্মেন্দ্র বয়ে আনেন ভালোবাসার সুবাতাস। আবেগপ্রবণ মীনা কুমারী তীব্রভাবে ভালোবেসে ফেলেন তাঁকে। তাঁকে তিনি ‘ধরম’ বলে ডাকতেন। ধর্মেন্দ্রও তাঁর ‘মীনাজি’কে ভালোবাসতেন, হয়তো সে ভালোবাসায় স্বার্থের ভাগটাই বেশি ছিল। মীনা কুমারীর বাড়ি ‘জানকী কুটির’-এ তিনি ছিলেন প্রতি সন্ধ্যার অতিথি। মীনা কুমারীর অ্যালকোহল আসক্তি তাঁর চেহারা ও স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিচ্ছিল। ফলে তাঁর ক্যারিয়ার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে ধর্মেন্দ্র ক্রমেই ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন অভিনয়ে। ফলে তিনি আর আগের মতো সময় দিতে পারছিলেন না তাঁর প্রেমিকাকে। দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ মীনা কুমারী এ দূরত্ব ঘোচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। যদি ‘ধরমের’ মনে ঈর্ষার আগুন জ্বালানো যায় তাহলে হয়তো আগের সেই আবেগের তীব্রতা ফিরে আসবে, এ ভাবনায় রাহুল নামে একটি ছেলের সঙ্গ গ্রহণ করেন মীনা। ধর্মেন্দ্র মুম্বাই ফিরে এসে ‘মীনাজি’র সঙ্গে ভালোবাসা কিংবা কৃতজ্ঞতা সূত্রেও কথা বলে সত্যতা যাচাইয়ের দরকার মনে করেননি। সেদিনই মীনার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেন তিনি চিরতরে। মীনা কুমারী এ ঘটনায় বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও হারিয়ে ফেলেন। মদে ডুবে যান তিনি। তাঁর লিভার দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লিভার সিরোসিসে মানে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন। ১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান তিনি। রুপালি পর্দায় বিয়োগান্ত চরিত্রেই মীনা কুমারীর জনপ্রিয়তা ছিল প্রবাদতুল্য, তাই ‘ট্র্যাজেডি কুইন’ উপাধি জোটে তাঁর কপালে। মৃত্যুর সময় হাসপাতালের টাকা পরিশোধ করার অর্থ ছিল না মীনার কাছে।