কোনটি নিয়ে আলোচনা করব! দেশে কী হচ্ছে নাকি কী হতে চলেছে। মানুষের সহজাত অভ্যাস হলো-তারা বাস্তবের চেয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। সত্যি কথা শোনার চেয়ে মিথ্যা আশ্বাস অথবা মিথ্যা প্রশংসা পছন্দ করে। আর নিষ্ঠুর বাস্তবতায় শত দুঃখকষ্টের মধ্যেও আগামী দিনে জিনপরি এসে পোলাও-কোর্মা খেতে দেবে-এমন স্বপ্নে বিভোর হওয়ার জন্য নিজের শেষ সম্বল দুই টাকা খরচ করে একটি তাবিজ কিনবে অথবা পাগলা বাবার দোয়া, ঝাড়ফুঁক লাভের জন্য ১০-২০ মাইল পায়ে হেঁটে শেষ কানাকড়িটুকু বাবার দানবাক্সে জমা করে আকাশকুসুম কল্পনা নিয়ে খালি পেটে বাড়ি ফিরবে।
আবহমান বাংলা এবং বাঙালির হাজার বছরের রুচি-অভ্যাস এবং চরিত্র থেকে আমরা যে বের হতে পারিনি তা হাল আমলে আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতি এবং ক্ষমতার কুশীলবদের কাণ্ডকারখানা দেখলেই অনুমান করা যাবে। দেশের আইনশৃঙ্খলার হযবরল অবস্থা তুঙ্গে। মব সন্ত্রাস, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে জোর যার মুল্লুক তার নীতির চূড়ান্ত তাণ্ডব। সন্ত্রাসীরা যে যেভাবে পারছে সেভাবে জুলুম-অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। অতীত চোরদের স্থলে নতুন চোর, পুরোনো জালেমদের স্থলে নয়া জালেম এবং আদি ডাকাতদের তাড়িয়ে নয়া বন্দোবস্তের ডাকাতরা যখন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে ঠিক তখন বাঙালি ইউরোপীয় রেনেসাঁর আদলে অতীতের সবকিছু ধুয়েমুছে পাকসাফ করার জন্য সংস্কার জিকিরে প্রকৃতি ও পরিবেশে ভয়ানক তাপ চাপ তৈরি করে ফেলেছে।
উল্লিখিত অবস্থায় আমাদের দেশ আজ এক ভয়ানক পরস্পরবিরোধী পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে দেশ দুধ-মধুর সাগরে ভাসছে। রপ্তানি বেড়েছে আর দেশি-বিদেশি টাকা, সোনা-রুপা, হীরা, মণি-মুক্তা ও জহরতে রাজভান্ডার কানায় কানায় ভরে উঠেছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক দেশের জিডিপি নিয়ে যে পূর্বাভাস দিচ্ছে তা যদি সত্যি হয় তবে ২০২৬ সালে দুর্ভিক্ষ, সামাজিক অশান্তি-এমনকি গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়বে। আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালে যে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষজনিত রোগবালাই, অপরাধ, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদির কারণে কমপক্ষে দুই কোটি লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অন্যদিকে লাখ লাখ পরিবার যেভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল তার ধকল আমাদের সমাজে আজও বিদ্যমান।
১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়ও দেশের জিডিপি ছিল শতকরা সাড়ে ৬ ভাগ। অথচ ২০২৫ সালের দুধ-মধুর নহর এবং বিশ্বমানবদের বাংলাদেশে জিডিপি সাড়ে ৩ ভাগ হতে পারে বলে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে। ২০২৪ সালের জিডিপির অর্ধেক জিডিপি নিয়ে ১৮ কোটি মানুষের দেশে যেসব অনাসৃষ্টি ঘটতে পারে তার ১ নম্বর অনাসৃষ্টি হলো দুর্ভিক্ষ। ২০২৬-২৭ সালের অর্থনৈতিক চালচিত্র নিয়ে বিশ্বব্যাংক যখন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল তখন ইরান- ইসরায়েল যুদ্ধ তো দূরের কথা যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। অধিকন্তু আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবে এমন সম্ভাবনা মাথায় রেখে বিশ্ব অর্থনীতির যে চালচিত্র বিশ্বব্যাংক তৈরি করেছিল তা এখনকার প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। চলমান ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি মাস খানেক চলে তবে আমাদের জিডিপি ৩ শতাংশের নিচে চলে আসবে- আর যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে আগামীর দুর্ভোগ যে কোন পর্যায়ে পড়বে তা অনুমানের জন্য পলাশীর যুদ্ধ-পরবর্তী দুর্ভিক্ষ এবং প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী দুর্ভিক্ষের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে যদি একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয় তবে বাঙালির স্বপ্ন চাঙে ওঠে রকেটের গতিতে চাঁদের দেশে চলে যাবে।
ইতিহাসের একজন ছাত্র হিসেবে আমি জানি যে মানবজীবনে একই ঘটনা বারবার ঘটে। একই ভুলের কবলে পড়ে একই মানুষ বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ, জাতি, রাজ্য, রাজা রাজধানীতে বারবার একই ঘটনা ঘটে। আজকের ইরানে যা ঘটছে তা মহামতী সাইরাসের জমানাতেও ঘটেছিল। সাইরাসের নানা রাজা হারপাগাস অথবা লিডিয়ার রাজা ক্রেসাস যে ভুল করেছিলেন তার ২০০ বছর পর আলেকজান্ডারও একই ভুল করেছিলেন। আবার মোঙ্গল নেতা হালাকু খান যে ভুল করেছিলেন তা অটোমান সম্রাট সুলেমান, তৃতীয় মুরসি অথবা প্রথম সেলিম করেননি। বাংলার ইতিহাসে ১০২৪ সালে যে ঘটনা ঘটেছিল প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। আবার ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ বাংলা ১১৭৬ সনে যা ঘটেছিল তা ২০২৬ সালে ধেয়ে আসছে ঠিক তখন আমরা সাতসমুদ্র তেরো নদী যখন পাড়ি দিয়ে লন্ডন প্যারিস ঘুরে বেড়াচ্ছি আর মনের আনন্দে গান ধরেছি বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল।
বুলবুলি বাংলার ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শব্দ। রাজার খাজনা ফাঁকি দেওয়ার জন্য যেভাবে বুলবুলির ধান খাওয়াকে দায়ী করা যায় তদ্রুপ আগামী দিনের সব সর্বনাশের জন্য বিএনপিকে দায়ী করার সব নীলনকশা যখন চূড়ান্ত ঠিক তখন লন্ডন গেট বৈঠকের জন্য শহীদ জিয়ার সৈনিকরা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে কবি নজরুলের উল্লিখিত বুলবুলির গানে সকাল-বিকাল রেওয়াজ শুরু করে দিয়েছি। জয় বাংলার বেহালের পর যখন ইনকিলাব জিন্দাবাদ-রাজুতে আর দিল্লি নয় পিন্ডি নয়-নয় অন্য কোন দেশ সেøাগানে আকাশবাতাস কাঁপছে, ঠিক তখন শত শত সিঁদুরে মেঘ-বাংলার ভাগ্যাকাশে ভিড় জমাচ্ছে রক্তবৃষ্টি ঘটানোর জন্য।
আমরা চলমান সময়ের দুরবস্থার দাফনকাফন বাদ দিয়ে জাতীয় সমস্যাকে পচিয়ে-গলিয়ে পুতিদুর্গন্ধময় লাশ বানিয়ে মাথায় নিয়ে উল্লাসে নৃত্য করছি এবং নাকে নস্যি, ঠোঁটে ঘি এবং কানে গোঁজা তুলো ঢুকিয়ে ভাবছি নির্বাচন কী ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে হবে নাকি ২০২৬ সালের জুন-এপ্রিল কিংবা ফেব্রুয়ারিতে হবে। আমরা ভাবছি নেতা আসবেন। ৩০-৪০ লাখ লোক নিয়ে নেতাকে বরণ করব আর সেই দৃশ্যে যমুনায় জোয়ার আসবে, বড় বড় ঢেউ হবে আর আমরা ঘপাঘপ বড় বড় রুই-কাতলা শিকার করব। নেতার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি এবং যার যার চরিত্র অনুযায়ী মোচে তা দিয়ে ২০৫০ সালের মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে মনের আনন্দে বুলবুলির সন্ধান করছি।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বিভাগ, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তর যখন অর্থনীতির টুঁটি-থুতনি, নাভি ইত্যাদি টানাটানি করছে তখন গত ১০ মাসে কেবল বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ৩০ লাখ নতুন অতিদরিদ্র বা হতদরিদ্র তৈরি হয়েছে, যার সিংহভাগ নারী। বিশ্বব্যাংক বলেনি, তবে আমরা অনুমান করতে পারি, দেশের কতসংখ্যক শ্রমশক্তি চাকরি বা কর্ম হারিয়ে বেকার হয়েছে। নতুন কর্মসংস্থান না হওয়ায় গত এক বছরে যারা চাকরিবাকরি বা কাজকর্মের জন্য লায়েক হয়েছে অর্থাৎ যে নতুন শ্রমশক্তি জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে, তা অব্যবহৃত থাকার কারণে যে মহাবিপদ তৈরি হয়েছে তার ঢেউ উন্মত্ত পদ্মা-মেঘনা-যমুনার ঢেউকেও ছাড়িয়ে যাবে।
উল্লিখিত অবস্থায় আমরা কী করছি তা যদি আপনাকে অনুধাবন করতে হয় তবে জাতীয় কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা বারবার পড়তে হবে। নজরুল যেভাবে জাহান্নামে বসে পুষ্পের হাসির কথা বলছেন তদ্রুপ আমরা অসহায় জনগণের অর্থ দিয়ে দেশ-জাতির সংস্কার করার জন্য জিহাদ শুরু করে দিয়েছি। আমরা একপক্ষ যেমন সংস্কার, করিডর, চট্টগ্রাম বন্দর লিজ দেওয়া নিয়ে মহাবীর হানিবলের সেই আল্পস পর্বতমালা পাড়ি দেওয়ার রেকর্ড ভঙ্গ করতে চাচ্ছি তদ্রুপ অপর পক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করে বিশ্ববিজয়ী জাদুকর ডেভিড কপারফিল্ডের মতো জাদুর ছোঁয়ায় পদ্মা-মেঘনা-যমুনার সব ঘোলা জলকে আবেহায়াত বানানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। ফলে আমাদের স্বপ্নও নিষ্ঠুর বাস্তবতা পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত করে অতীতে যেভাবে আমাদের সর্বনাশ ঘটিয়েছে তা সুদে আসলে একত্র হয়ে ভবিষ্যতে কত বড় বিপর্যয় তৈরি করতে যাচ্ছে, তা আমরা টের না পেলেও আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক দুনিয়া কিন্তু ঠিকই বুঝতে পেরেছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক