দুই বছর আগে স্ত্রী ও ১২ বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়েছিলেন ঢাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। পরিবার নিয়ে নেমেছিলেন সাগরের পানিতে। মুহূর্তগুলোকে ফ্রেমে আটকাতে বিচের ফটোগ্রাফার দিয়ে তুলেছিলেন ছবি। সম্প্রতি তার এক বন্ধু তাকে একটি ভিডিও লিঙ্ক পাঠায়। লিঙ্কে ক্লিক করতেই সামনে ভেসে ওঠে সাগরের পানিতে তার স্ত্রী ও মেয়ের ঝাপাঝাপির দৃশ্য। ভিডিওতে তার স্ত্রী ও কন্যাকে কখনো স্লো মোশনে, কখনো জুম করে আপত্তিকরভাবে দেখানো হয়েছে। পরে আরও কয়েকটি পেজে খুঁজে পান একই ভিডিও। তিন দিনের সেই কক্সবাজার ভ্রমণ এখন শরিফুলের জীবনের বড় অভিশাপ।
শরিফুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাগরে গোসল করতে গেলে ভেজা কাপড় শরীরের সঙ্গে লেপ্টে যাবে- এটাই স্বাভাবিক। অথচ পারিবারিক সেই দৃশ্য এখন সারা পৃথিবীতে নিলাম হয়ে গেছে। মেয়েটি বড় হচ্ছে। পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের সামনে মুখ দেখাতে পারি না। জানা যায়, সম্প্রতি কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, ফ্যান্টাসি কিংডম, বিভিন্ন ওয়াটার পার্ক ও অন্যান্য জনপ্রিয় পর্যটন স্পটে নারী পর্যটকদের অজ্ঞাতসারে গোসলের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। কখনো পর্যটকদের ভাড়াটে ফটোগ্রাফার হিসেবে কখনো তাদের অজান্তেই এসব অসাধু চক্রের ক্যামেরায় ধরা পড়ছেন অনেক নারী। রেহাই পাচ্ছে না শিশুও। ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব ছাড়াও এসব ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে অনেক পর্নোগ্রাফিক সাইটে। সামাজিকমাধ্যমে ফলোয়ার, সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে এভাবেই টার্গেট করা হচ্ছে নারীদের। এতে লাখ লাখ ফলোয়ারের এসব পেজের ভিডিও মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। এতে সামাজিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছে ওই নারী ও তার পরিবার। এসব ভিডিও ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে বছরের পর বছর। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইউটিউবে অ্যাডভ্যাঞ্চারসিকে৭৭ নামের একটি চ্যানেলে থাকা ৯৬টি ভিডিওর সবগুলোতেই নারীদের গোসলের দৃশ্য। ফেসবুকে সাদিয়া আক্তার জুঁই নামের পেজটিতে ফলোয়ার প্রায় আড়াই লাখ। ওই পেজজুড়ে রয়েছে বিনোদন কেন্দ্রে নারীদের গোসলের অসংখ্য ভিডিও।
এ ছাড়া জলপরী, খান ভাই, স্টার আপলোড ভিড, জাস্ট সুইমিং), লাকভেলকিলাক), ডানিয়েল শিকদার, ফায়জান আবির খান নামের বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও প্রোফাইলে রয়েছে এমন ধরনের একই ভিডিওর ছড়াছড়ি। কিন্তু এসব পেজ বন্ধে নেই কোনো উদ্যোগ। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গাজী মোহাম্মদ তৌহিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনুমতি ছাড়া নারীর ছবি তোলা বা ভিডিও করা স্পষ্টভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় অপরাধ। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনসহ অনেক আইনে এ ধরনের অপরাধের জন্য কঠোর সাজার বিধান আছে। যথাযথ মনিটরিং ও সচেতনতার অভাবে দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আত্মসম্মানের ভয়ে অনেকে অভিযোগ করছেন না। ফলে অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
তবে অনেক সময় ভুক্তভোগী ভিডিওর কথা জানতে পারে অনেক পরে। ফলে সামাজিকভাবে তাকে হেয় হতেই হচ্ছে। তাই পর্যটন স্পটগুলোতে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. মাইনুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা পর্যটকদের নিরাপত্তায় সদা তৎপর থাকি। তবে কে কখন কার ছবি তুলছে, ভিডিও করছে তা দেখা সম্ভব হয় না। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দিলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর গোপনীয়তা ও মর্যাদা রক্ষা করা শুধু আইনগত দায় নয়, বরং এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব। পর্যটন এলাকা নারীবান্ধব না হলে নারী পর্যটক যেমন সরে যাবে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের পর্যটন সম্ভাবনা। এজন্য আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোরতা ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ, পর্যটন এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক নারী ও সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভুক্তভোগীদের সাহস জোগাতে সামাজিক সহায়তা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা দরকার।