মানবজীবনের মহাকাব্য যেন রচিত হয়েছে এক পরম সত্তার করুণার অক্ষরে। আমাদের জীবনের প্রতিটি স্পন্দন, প্রতিটি নিঃশ্বাস, এমনকি নিঃশব্দ অনুভবেও অনুরণিত হয় তাঁরই অসীম দয়ার প্রতিধ্বনি। এ চিরন্তন সত্যটি পবিত্র কোরআনে এক মহান বাণী হয়ে প্রকাশিত হয়েছে- ‘তোমরা যদি আল্লাহর নেয়ামত গুনতে চাও তবে গুনে শেষ করতে পারবে না।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত ৩৪)। একটি মাত্র আয়াতই আমাদের চেতনায় এক গভীর আলোড়ন তোলে। যেন মনে হয়, আমাদের অস্তিত্ব কেবল এক জৈবিক বাস্তবতা নয়, বরং স্রষ্টার অনুগ্রহে আবৃত এক চলমান বিস্ময়। ভেবে দেখলে আশ্চর্য লাগে, এক ফোঁটা পানি থেকে গঠিত দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, প্রতিটি কোষ কত নিপুণ শিল্পে গড়া! সেই অবয়বে তিনি দান করেছেন বুদ্ধি, বোধ, অনুভব। মানুষকে দিয়েছেন সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। এ দেহ এক জীবন্ত রাজপ্রাসাদ, যার জানালা দিয়ে দেখা যায় জগতের নানা রং, কর্ণে ধ্বনিত হয় জীবনের অনন্য সংগীত আর হৃদয়ের ধুপধাপ ধ্বনি যেন এক অব্যক্ত স্তবগান। এসবই আসলে স্রষ্টার প্রতি প্রেম ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। আমরা বুঝি না, উপলব্ধি করি না, যতক্ষণ না শরীরের কোনো একটি অংশ থেমে যায় বা কষ্ট দেয়। তখনই টের পাই, সুস্থতা কত বড় এক নেয়ামত!
এ দেহ চালাতে ও টিকিয়ে রাখতে প্রকৃতি যেন হয়ে উঠেছে এক নিঃশব্দ কারিগর। অবারিত রিজিকের ভান্ডার সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। ভোরের সোনালি আলো, দুপুরের শস্য-গন্ধ, রাতের নক্ষত্রবিহার কিংবা বৃষ্টির ফোঁটা-সবই তাঁর অফুরন্ত দয়ার প্রতিচ্ছবি। এ নিখুঁত ব্যবস্থা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা একা নই, আমাদের প্রতিটি প্রয়োজন তিনি জানেন এবং অপূর্ব প্রজ্ঞায় তা পূরণ করে চলেছেন। এমনকি এমন অনেক নেয়ামত আমাদের জীবনে এসেছে যা আমরা চাইওনি, বুঝতেও পারিনি, তবু তিনি দিয়েছেন, কারণ তিনি জানেন কখন কী প্রয়োজন। তবে আমাদের জীবনের প্রয়োজন শুধু দেহগত নয়, আত্মারও এক তীব্র পিপাসা রয়েছে। সেই আত্মিক চাহিদা পূরণের জন্যই তিনি পাঠিয়েছেন পথ প্রদর্শক নবীদের, সর্বশেষ রসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এবং দিয়েছেন পবিত্র কোরআন, যা মানবতার জন্য চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা। এই এক অনন্য আলো যা বিভ্রান্তির আঁধারে দিক দেখায়, ক্লান্ত অন্তরকে দেয় প্রশান্তি ও শক্তি। রসুল (সা.)-এর জীবনযাপন ছিল সেই আলোরই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি-সততা, দয়া, ক্ষমা ও আত্মত্যাগের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত।
মানুষ হিসেবে আমরা ভুল করি, ভ্রষ্ট হই; কিন্তু কী আশ্চর্য, সেই ভুলের পরও তিনি রেখে দিয়েছেন প্রত্যাবর্তনের রাজপথ-তওবা। তাঁর দরজা কখনো বন্ধ হয় না। বরং বান্দার এক ফোঁটা অনুতাপে তিনি বর্ষণ করেন করুণার বৃষ্টি। তাঁর দয়ার বিস্তৃতি এতটাই ব্যাপক যে তা বান্দার সব অপরাধকে ছাপিয়ে যায়। এ ক্ষমা-নিবৃত্তি আমাদের শেখায় হতাশা নয়-আশাই মুমিনের সত্যিকার শক্তি। এমনকি আমাদের গোপনতম ব্যথাও তিনি জানেন এবং কখনো কখনো চোখের জলের মধ্য দিয়েই আমাদের অন্তরের বোঝা হালকা করে দেন। আমাদের জীবনকে তিনি করেছেন আরও অর্থবহ, পরিবার বন্ধন ও ভালোবাসা দিয়ে। ভালোবাসার এ সুতোয় গাঁথা সম্পর্কগুলোই আমাদের হৃদয়কে নরম রাখে, মানুষ রাখে, জীবনের ক্যানভাসে আঁকে উষ্ণতার রং। কখনো জীবনে আসে ঝড়, রোগ, শোক কিংবা বিপদ-তখনো তা নিছক শাস্তি নয়; বরং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন। ধৈর্য, দৃঢ়তা ও স্রষ্টার ওপর নির্ভরতার পরীক্ষায় তিনি আমাদের তুলে আনেন নতুন উচ্চতায়। আমাদের ব্যর্থতা কখনো কখনো হয়ে ওঠে সফলতার প্রস্তুতিমঞ্চ আর প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের শেখায় বিনয় ও নির্ভরতার প্রকৃত অর্থ। এ মহাযাত্রার শেষ প্রান্তে রয়েছে চূড়ান্ত পুরস্কার জান্নাত, যেখানে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই; শুধু শান্তি, আনন্দ আর তাঁর সান্নিধ্য। আমাদের ক্ষুদ্র আমল এবং সীমিত সাধনার বিনিময়ে এমন এক অনন্ত পুরস্কার এটা একমাত্র সম্ভব তাঁর সীমাহীন ভালোবাসার ফলেই।
বস্তুত আমরা প্রতিনিয়ত এক রহমতের চাদরে আবৃত। তাই কৃতজ্ঞতা যেন শুধু মুখের বুলি না হয়ে ওঠে; বরং তা হোক হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত অনুভব, যা প্রতিফলিত হবে আমাদের প্রতিটি কাজে, সেজদায় ও মানুষের সঙ্গে আচরণে। কারণ একমাত্র কৃতজ্ঞ হৃদয়ই পারে স্রষ্টার ভালোবাসার অসীম আকাশে ডানা মেলতে এবং তাঁর আরও সান্নিধ্য লাভ করতে। প্রতিদিনের ছোট ছোট নিয়ামতের স্বীকৃতি, একটি সৎকাজ, একটি বিনম্র দোয়া সবই হতে পারে তাঁর সস্তুষ্টির দিকে এক দৃপ্ত পদক্ষেপ।
এ কৃতজ্ঞতার ভাষা শুধু হৃদয়ের গভীরে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, তা যেন ছড়িয়ে পড়ে আমাদের জীবনাচরণে-পরিবারে, সমাজে, কর্মস্থলে এবং সবার ওপরে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যে। যে ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি পরিপূর্ণতা, সীমাবদ্ধতা এবং দুঃখকেও স্রষ্টার পক্ষ থেকে এক নেয়ামত হিসেবে দেখে সে কখনোই খালি হাতে থাকে না, তার হৃদয় থাকে পরিপূর্ণ, আত্মা থাকে প্রশান্ত। কারণ কৃতজ্ঞতা মানেই আশীর্বাদকে স্বীকৃতি দেওয়া, আর সেই স্বীকৃতি নিজেই নতুন নতুন আশীর্বাদের দরজা খুলে দেয়।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, চরপাথালিয়া সালমান ফারসি (রা.) মাদরাসা, গজারিয়া, মুন্সিগঞ্জ