ইসলাম ধর্মে ঐক্যের গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর ও মৌলিক। ঐক্য মুসলমানদের মধ্যে সংহতি সৃষ্টি করে। প্রসারিত করে পরস্পর সহযোগিতার দ্বার। ঐক্য একটি বন্ধন, যা মুসলমানদের শক্তিশালী করে। সমাজে শান্তি এবং স্থিরতা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস সুদৃঢ় করে। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘সব মুমিন একে অন্যের ভাই’ (আল হুজরাত-১০)।
রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর অসংখ্য বাণীতে ঐক্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বলেন, ‘মুমিনগণ পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতিতে একটি দেহের মতো। যখন দেহের কোনো একটি অঙ্গ ব্যথিত হয়, তখন গোটা দেহই জেগে ওঠে এবং জ্বরে আক্রান্ত হয়’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। মুসলিম হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকা, গোটা বিশ্ব মুসলিম মুসলমান হিসেবে শত্রুর মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া, ইসলামের স্বার্থে মতভেদ পরিহার করা, ইমানের দাবি। মুসলিম উম্মাহ বিভক্ত হলে শত্রুরা সহজেই ধর্ম ও সংস্কৃতিতে আঘাত করতে পারে। ঐক্যের মাধ্যমে মুসলমানরা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ অবস্থান নিতে পারে। যা উপরোল্লিখিত হাদিসে মহানবী (সা.) ইঙ্গিত করেছেন। তাই ইসলামকে টিকিয়ে রাখা এবং বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মর্যাদা রক্ষায় পরস্পর ঐক্যই মূল চাবিকাঠি। মুসলিম ঐক্যের প্রধান ইস্যু এবং প্রথম ভিত্তি হলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে বলবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (সহিহ বুখারি)।
সারা বিশ্বে মুসলমানরা নিপীড়িত-নির্যাতিত। ফিলিস্তিন, গাজা, উইঘুর এবং বিশ্বের আরও বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান আজ লাঞ্ছিত-বঞ্চিত। সর্বদা চলছে হত্যা, গণহত্যা নির্বিচারে। অনেক দেশে মুসলমানরা আপন আপন ভূখণ্ডে অবহেলিত এবং চরম বৈষম্যের শিকার। এ পরিসরে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই। নেই বিভেদ ও বিভাজন সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ। ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইমানের দাবি। অথচ মুসলিম বিশ্ব আজ বিভেদ, বিসংবাদ ও কলহে জর্জরিত। মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে নানা মত ও পথ। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ স্বার্থে বিভক্ত। ফলে এই বৃহত্তর ইমানি স্বার্থেও মুসলমান দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধভাবে লড়াই করে, যেন তারা সিসা গালানো প্রাচীর’ (সুরা আস সাফ- ৪)।
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ঐক্যের বাস্তব আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ’ (সুরা আলে ইমরান)।
ইসলামি বিধিবিধান পালন এবং প্রচার-প্রচারের ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্র এবং কর্মপন্থায় যদি সবাই একমত হয় তাহলে এই কাজ সক্রিয় হবে, ব্যাপক হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব যাবতীয় ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিসীম। কিছু ক্ষেত্রে মতভেদ করার তো কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে কোরআন এবং হাদিসের অকাট্য দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত কোনো বিষয়ে মতভেদ করার সুযোগ ইসলাম ধর্মে নেই। যেমন আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ ইত্যাদি। অন্যদিকে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিধিবিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ঐক্যের মাধ্যমে যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, অনৈক্যের পরিস্থিতিতে সেই সফলতা অর্জন আশা করা যায় না। তবে এসব বিষয়ে কর্মক্ষেত্র এবং কর্মপন্থা কেমন হবে, কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা কোরআন-হাদিসের আলোকে সঠিক হবে, কীভাবে বাস্তব সফলতা অর্জন হবে, ইত্যাদি ক্ষেত্রে মতভেদ হতে পারে। যদিও কোনো ক্ষেত্রেই মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ কাম্য নয়। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত ইসলামি আকিদা ও ধর্মীয় বিধিবিধানে নমনীয়তা ও অবনতি করে ঐক্য, কোরআন এবং হাদিস পরিপন্থি কোনো আকিদা বা বিষয়ে সমর্থন ও নীরবতা মূলকভাবে ঐক্য, ইসলাম ও মুসলমানদের অবমাননার পরিস্থিতিতে ঐক্য, আল্লাহ ও রসুলের শত্রুদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ঐক্য ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ নির্দেশ করেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না’ (আলে ইমরান-১০৩)। আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা.) এবং ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহর রজ্জু’-এর মর্মার্থ হলো, আল কোরআন, ইসলাম বা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার। অতএব, আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী ‘আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর’ এর মর্ম হলো তোমরা আল্লাহর কোরআন, ইসলামের সঠিক নীতি বা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার সুদৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধভাবে ধারণ করো। (তাফসিরে তাবারি)।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা