সরকারি ওষুধ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগসের কারখানা স্থাপনের জন্য উদ্যোগ হাতে নেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) মানিকগঞ্জে কারখানা স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প পাস হয়েছিল। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি পাস হয়। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৭ সালের মার্চ পর্যন্ত। প্রকল্পের জন্য মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের মেঘশিমুল এলাকায় সাড়ে ৩১ একর জমি প্রস্তাব করা হয়। যেসব মৌজায় এসব জমি পড়েছে তার অধিকাংশই সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার ছেলেমেয়েদের নামে। কিছু জমি মেয়ের স্বামীর নামেও দানপত্র করা হয়েছিল। প্রকল্প পাসের পর অধিগ্রহণ হলে তিন গুণ দামে জমিগুলো বিক্রি করতে পারবেন, এমনটা পরিকল্পনায় ছিল তাদের। এতে সরকারের ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে বলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আবদুল লতিফ।
কারখানাটি প্রাথমিকভাবে স্থাপনের জন্য জায়গা নির্ধারণ হয় জেলা সদর উপজেলার উকিয়ারা। সরকারি অর্থ আত্মসাতের জন্য নিজ ও তার পরিবারের অন্য সদস্য এবং আওয়ামী লীগের অনুসারীদের নামে ৩১ একর জমি কেনেন জাহিদ মালেক। সেই নিচু জমিতে বালু ভরাট করে মৌজার মূল্য বাড়ানোর পাঁয়তারাও করেন তিনি। জমিটি মন্ত্রণালয় থেকে দেখতে গেলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুল লতিফ জমির মূল্য বেশি এবং নাল জমি আবাসিক দেখানোর কারণে বাগড়া দেন। ওই সময় সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন এবং জেলা প্রশাসকের অপসারণের জন্য জোর তদবির করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের একাংশ ও জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জেলা প্রশাসককে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়ে হুঁশিয়ারি দেয়। পরবর্তীতে তৎকালীন ডিসি আবদুল লতিফের বদলির পরপরই জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী রেহেনা আখতার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর রেহেনা আখতার বদলি হন। জেলার লার সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া ইউনিয়নের কামতা মৌজায় পৈতৃকভাবে ১৫ বিঘা নিচু জমি ছিল। সেই নিচু জমি ভরাটের উদ্যোগ নেন জাহিদ মালেক। অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা একাধারে ড্রেজার দিয়ে রাতারাতি বালু ফেলা হয়। নিচু জমিতে বালু ফেলার সময় নাহার গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী খাদেমুল ইসলাম পিনুর ৭৮ শতাংশ জমি দখল করে নেন জাহিদ মালেক। জমি দখলের পর পরই পাল্টা মামলাও দেন পিনুর বিরুদ্ধে। জমি ভরাট হয়ে গেলে দখলে নিতে সবজির আড়ত ও গরুর হাট বসান তিনি। গরুর হাট কয়েক দিন চললেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায় এবং সবজির আড়তের দোকান বরাদ্দের নামে বেশ কিছু মানুষের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় মালেক বাহিনীর নেতা-কর্মীরা। অপর দিকে সদর উপজেলার জাগীর অঞ্চলে সাবেক মন্ত্রী কার্বন হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি কারখানা স্থাপন করে। কারখানাটি স্থাপন করার সময় জমির মালিকরা জমি দিতে চাচ্ছিলেন না। ওই সময় আওয়ামী লীগের বিশেষ একটি অংশ কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে জমি দখল করে ও জমি নিজের নামে করে নেয়। অভিযোগ রয়েছে, তিনজনের কাছ থেকে ১৭ শতাংশ জমি জবরদখল করে নেওয়া হয়, যার বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। নাহার গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী খাদেমুল ইসলাম পিনু বলেন, আমার প্রয়াত বাবা ৯০ বিঘা জমির ওপর নাহার গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের জমির পাশেই জাহিদ মালেকের পৈতৃক কিছু জায়গা ছিল এবং তাদের সম্পদের পাশে আমাদের ৭৮ শতাংশ জমি ছিল। কাঁচা বাজারের আড়ত করার সময় জাহিদ মালেক জোর করে আমাদের জায়গা দখল করে নেন। জমি দখলের পর থেকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে জাহিদ মালেকের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা। দলিল করে দিতে অস্বীকার করলে নানাভাবে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দেয় আমাদের নামে। এসব বিষয় শুনে আমার বৃদ্ধ মা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। বিভিন্ন চাপে মধ্যে ফেলে নামমাত্র অর্থে বিনিময়ে জমি দলিল করে নেয়। তৎকালীন কামতা-গোলড়া কাঁচামালের আড়তের মালিক রাজ্জাক বলেন, আমাদের পৈতৃক জায়গার ওপর কাঁচামালের আড়ত ছিল। সাবেক মন্ত্রী জাহিদ মালেক বাহিনী আমাদের আড়তের পাইকারদের আসতে বাধা প্রয়োগ করে। একটি সময় আমাদের আড়ত বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিন উকিয়ারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এসেনশিয়াল ড্রাগস কারখানার জন্য প্রস্তাবিত ওই জমিটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। উঁচু ভিটায় জন্মেছে কাশফুলসহ আগাছা। এ সময় কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়। এদেরই একজন কৃষক আবদুস সালাম জানান, তার গভীর নলকূপের আওতায় ১১০ বিঘা কৃষিজমি জোরপূর্বক ভরাট করে নামমাত্র দাম দিয়েছেন সাবেক মন্ত্রী। ৯২ শতাংশ জমির কোনো মূল্যই দেননি। কিছু বললেই তার লোকজন ভয় দেখাত। হুমকি-ধমকি দিত। তিনি বলেন, আমি নিজে হাজার থেকে ১২ শ মণ ধান পেতাম। এলাকায় ধান হতো ৭-৮ হাজার মণ। এই ফসলে সারা বছর সংসার চলত মানুষের। অথচ ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে জমিগুলো দখল করে নিল।
একই অভিযোগ ইউনুছ আলীরও। তিনি জানান, চারপাশে বাঁধ দিয়ে মাঝখানে তার জমি আটকিয়ে ফেলেছিল। এরপর লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। পরে বাধ্য হয়ে বিক্রি করে দিই। কিন্তু জমির দাম লাখ টাকা শতাংশ হলেও, তাকে মাত্র ৪০ হাজার টাকা শতাংশ মূল্য দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ওই জায়গায় কারখানা হলো না। অথচ জমিগুলো হারাতে হলো।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে জাহিদ মালেক ও তার ছেলেমেয়েদের নামে থাকা বিপুল সম্পদের তথ্য। এক মানিকগঞ্জেই এ পরিবারের নামে থাকা ৬ হাজার ৫৩ শতাংশ জমির তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। সম্প্রতি জেলার সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছিল দুদক। সেই চিঠির জবাবে তাদের নামে ৬ হাজার ৫৩ শতাংশ জমির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন মৌজায় কেনা এসব জমির মধ্যে জাহিদ মালেকের নামেই রয়েছে ২ হাজার ১৯৩.০৫৩ শতাংশ। তার ছেলে রাহাত মালেকের নামে ১ হাজার ৭৪২.০১৬ শতাংশ এবং ১ হাজার ১১৮.৭৮ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে মেয়ে সিনথিয়া মালেকের নামে। বিপুল পরিমাণ এই জমির বাজারমূল্যও টাকার অঙ্কে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন দুদকের অনুসন্ধান-সংশ্লিষ্টরা। তবে জমির দলিলমূল্যে দাম অনেক কম দেখানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা সবে অনুসন্ধানটা শুরু করেছি। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে আমাদের কাছে। এসব অভিযোগের অংশ হিসেবে মানিকগঞ্জে জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই জমিগুলোর তথ্য এসেছে। দুদক সূত্র জানায়, মানিকগঞ্জে জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে যে ৬ হাজার শতক জমি ছেলে রাহাত মালেকের নামে ৯১টি দলিল, মেয়ে সিনথিয়ার নামে ২২টি এবং জাহিদ মালেকের নামে রয়েছে ৪৬টি দলিল।