কয়েক বছর আগে চরের পরিসংখ্যান খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, চর অবজ্ঞার নির্মম চিত্র। চরের পরিসংখ্যান জানতে চেয়ে নদীবেষ্টিত একটি উপজেলার ভূমি অফিসে খোঁজ নেওয়া হয়। তারা জানায় তাদের কাছে চরের জমির কোনো পরিসংখ্যান নেই। জেলা প্রশাসন পর্যায়ে খোঁজ নিলে হয়তো পাওয়া যাবে। জেলা পর্যায় থেকে বলা হয়, তাদের কাছেও কোনো পরিসংখ্যান নেই। তারা জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ডে খোঁজ নিতে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বলা হয় ঢাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডে খোঁজ নেন। ঢাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বলা হয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিতে। সেখানেও চরের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া গেল না। তারা জানাল, ভূমি মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিতে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব পর্যায় থেকে বলা হলো, ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগে চরের তথ্য থাকতে পারে। প্রশাসন বিভাগ থেকে বলা হয় জরিপ শাখায় খোঁজ নিয়ে দেখেন। জরিপ শাখা থেকে বলা হলো, আইন শাখায় খোঁজ নেন, সেখানে চরের তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এভাবে সরকারের তিনটি মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়েও চরের প্রকৃত সংখ্যা এবং চরে কত মানুষ বাস করে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে নানা তথ্য বিশ্লেষণে ধারণা করা যায়, সারা দেশে ৫ হাজারের ওপর চর রয়েছে। এসব চরে দুই কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে। এসব মানুষের মৌলিক অধিকার এবং চরের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের আলাদা কোনো চিন্তাভাবনা নেই। কী দুর্ভাগ্যজনক প্রশাসনিক দীনতা! যেটুকু উন্নয়ন হচ্ছে তা বিচ্ছিন্নভাবে। বলা চলে অনেকটা এনজিওনির্ভর। সম্প্রতি বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে চর উন্নয়নে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের। এ দেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর পলিসমৃদ্ধ একটি বৃহৎ ব-দ্বীপ। নদীর পরিসংখ্যান নিয়েও মতভেদ রয়েছে। তবে দেশে কয়েক শ নদী এখনো বহমান।
যার মধ্যে ৫৭টি সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এই অভিন্ন নদীগুলোর ৫৪টি ভারত এবং তিনটি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর ১৭ দশমিক ২ লাখ বর্গকিলোমিটার ক্যাচমেন্ট এরিয়ার ১ হাজার ৩৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার পলি প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরে পড়ে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। অথচ বাংলাদেশে ক্যাচমেন্ট এরিয়ার মাত্র ৭ শতাংশ অবস্থিত। মূলত বিপুল পরিমাণ পলিবহন এবং পলি দ্বারা গড়ে ওঠা অববাহিকার মধ্য দিয়ে এসব নদী প্রবাহিত হওয়ায় এগুলোর ভাঙাগড়ার প্রবণতাও বেশি। ভাঙাগড়ার এই খেলায় প্রতি বছরই নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। বসতভিটা হারিয়ে নদীভাঙা মানুষ চরে গিয়ে বসতি গড়ছে। এই বসতি গড়া মানুষগুলো চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। তাদের জীবনমান উন্নয়নে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার তেমন একটা উন্নয়ন নেই বললেই চলে। তিস্তাও প্রতি বছর কোটি মেট্রিক টন পলি বহন করে। যমুনা নদী প্রতি বছর নতুন নতুন চ্যানেল সৃষ্টি অথবা পরিত্যক্ত হওয়া নদীর স্বাভাবিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। ফলে নৌ চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ৬০ বছর আগে স্টিমার চলাচল করলেও বর্তমানে এটি একটি পরিত্যক্ত চ্যানেলে পরিণত হয়েছে। এর বুক চিড়ে জেগে উঠেছে শত শত চর। এসব চরে গড়ে উঠছে জনবহুল জনবসতি। এ ছাড়া গঙ্গার শাখা নদী মধুমতী, ভৈরব, চিত্রা, গড়াই, চন্দনা ও গড়াই এবং তিস্তা, করতোয়া, ধরলাসহ প্রতিটি নদীর একই অবস্থা। বাংলাদেশের নদীগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার। তার মধ্যে বর্ষা মৌসুমে নৌচলাচল করতে পারে মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটার। আর সারা বছর পানি থাকে মাত্র ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার এলাকায়। অথচ দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষেরই পরিবহনব্যবস্থা এককভাবে নৌপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল ছিল একসময়। দেশের ২ লাখ ৭৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথের তুলনায় নৌপথ অপেক্ষাকৃত কম দৈর্ঘ্যরে। মাত্র ২৪ হাজার কিলোমিটার হলেও এর বিস্তৃতি অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের নদীগুলোর পানিপ্রবাহ হ্রাস, ক্রস-বাউন্ডারি প্রবাহ হ্রাস, পলিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং জোয়ারের প্রবাহ কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে নাব্য হারিয়ে নতুন নতুন ভূখণ্ড বের হচ্ছে। এসব ভূখণ্ডের সঠিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান চাই। এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এই প্রত্যাশা চরের মানুষদের।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী