রাজনীতিকে বলা হয়, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। দর্শন, সমাজ, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতির সামষ্টিক রূপ হলো রাজনীতি। রাজনীতি সমাজবিজ্ঞান। কিন্তু বর্তমান সময়ে রাজনীতি যেন হিসাবনিকাশের খেলা। রাজনীতি এখন গণিতের চেয়েও জটিল। যোগবিয়োগের হিসাবনিকাশে এখন রাজনীতির কৌশল নির্ধারণ করা হয়। আদর্শ এখন গৌণ। লাভক্ষতির হিসাব করে রাজনৈতিক দলগুলো পা ফেলে। প্লাস-মাইনাসের গোলকধাঁধায় বাংলাদেশের রাজনীতিও। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে চলছে নানা অঙ্কের খেলা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের আগেই এ হিসাব কষেই বিভিন্ন দল নানা রকম দাবিদাওয়া নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
প্লাস-মাইনাসের হিসাব করেই জামায়াত তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আদর্শিক দূরত্ব ঘুচিয়ে অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। জামায়াতের রাজনৈতিক অঙ্কের হিসাব পরিষ্কার। তাদের রাজনৈতিক কৌশল তিন মাইনাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। প্রথমত, তারা বিএনপিকে রাজনীতির মাঠে নিঃসঙ্গ করতে চায়। বিএনপি বিগত ১৬ বছর ধরে যে আওয়ামী লীগ বিরোধী ঐক্য গড়ে তুলেছে, তাতে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করেছে।
যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের বিএনপির থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে জামায়াত নির্বাচনে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। দ্বিতীয়ত, জামায়াত আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে মাইনাস করতে চায়। জাতীয় পার্টি যদি নিষিদ্ধ হয় কিংবা তারা যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে তাহলে জামায়াত লাভবান হবে। তৃতীয়ত, জামায়াত বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়। এ জন্যই জামায়াত, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট নিষিদ্ধ করার দাবি করছে। জামায়াত মনে করে, এই তিন মাইনাস সফল হলে, আগামী নির্বাচনে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। জামায়াত অনেক গোছানো একটি দল। তারা সবকিছু করে দীর্ঘ পরিকল্পনা করে। পরিকল্পিতভাবেই তারা ছাত্রলীগের মধ্যে শক্তিশালী ছাত্রশিবির তৈরি করেছে। পরিকল্পনা করেই তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আইন-বিচারে বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। কিন্তু সমস্যা হলো, জামায়াতের একনিষ্ঠ কর্মী বাহিনী, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিজস্ব লোক থাকার পরও, নির্বাচনি দৌড়ে তারা পিছিয়ে। এর কারণ, সাধারণ মানুষের মধ্যে জামায়াত এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি। সাধারণ ভোটাররা জামায়াতকে ভোট দিতে এখনো প্রস্তুত নয়। আর এটি তো সবাই জানে, দল যত শক্তিশালী হোক। কর্মীরা যতই নিবেদিত প্রাণ হোক, নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন ছাড়া নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায় না। নির্বাচনে জামায়াতের আরও একটি মৌলিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দলটির সংগঠন সারা দেশে সমানভাবে শক্তিশালী নয়। জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলত বিশটি জেলাকে ঘিরে। অন্য জেলাগুলোতে জামায়াতের সংগঠন থাকলেও দুর্বল। কাজেই ৩০০ আসনের মধ্যে ১২০টি আসনে জামায়াতের প্রার্থীরা ভোটারদের দৃষ্টিআকর্ষণ করতে পারবে। অন্য আসনে প্রার্থী দিলেও খুব বেশি কিছু করতে পারবে না। জামায়াতের সুবিধা হলো, তারা মাঠের বাস্তবতা বুঝে। নির্মোহভাবে মাঠ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে পারাটা এই দলের বড় যোগ্যতা। বাংলাদেশে এখন জামায়াতের জন্য যতই অনুকূল পরিবেশ থাকুক না কেন, এত কম সময়ে তারা সারা দেশে ৩০০ আসনে বিএনপির মতো শক্তিশালী এবং দেশব্যাপী বিস্তৃত দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। এ জন্যই তারা পিআর পদ্ধতি নিয়ে মাঠে নেমেছে। ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন হলে, সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে জামায়াত। পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের মতো ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কতটা বিপজ্জনক সেই আলোচনা এখানে করতে চাই না। এনিয়ে রাজনীতির মাঠে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চলছে। আমি শুধু পিআর পদ্ধতির কয়েকটি উদ্বেগজনক দিক তুলে ধরতে চাই। পিআর পদ্ধতিতে একটি দলের ভিতর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। দলের নেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সংসদ সদস্য মনোনীত হন। এ পদ্ধতিতে জনগণের পছন্দ গৌণ হয়ে যায়। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটি প্রমাণিত সত্য যে, দলে গণতন্ত্র না থাকলে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র চর্চা সম্ভব নয়। প্রতিটি নির্বাচনি এলাকার মানুষের চাওয়া-পাওয়া ভিন্ন। তাদের সমস্যা এবং অগ্রাধিকার পৃথক। একটি নির্বাচনি এলাকায় ভোটাররা শুধু দল কিংবা প্রতীক দেখে ভোট দেন না। তারা পছন্দের প্রার্থীও খুঁজেন। এমন একজন প্রার্থীকে জনগণ ভোট দিতে চায়, যিনি এলাকার সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। যাকে এলাকাবাসী সুখে-দুঃখে পাশে পায়। দলের চেয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ। পিআর পদ্ধতি জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্যহীন করে দেয়। জনগণের ওপর দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্যিকার গণতন্ত্রের সঙ্গে পিআর পদ্ধতি সাংঘর্ষিক। এরকম অনেক যুক্তি আছে। সে প্রসঙ্গে এখানে বিতর্ক করতে চাই না। শুধু একটি কথা বলা দরকার, এবারের নির্বাচন বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আর এই সংবিধান অনুযায়ী পিআর পদ্ধতি অসম্ভব। জামায়াত দুই কারণে পিআর ইস্যুকে সামনে এনেছে। প্রথমত, এর মাধ্যমে তারা নির্বাচনের প্রধান ইস্যুগুলোকে আড়াল করতে চায়। দ্বিতীয়ত, এই দাবি তুলে তারা দীর্ঘ মেয়াদে বিএনপিকে চাপে রাখতে চায়। তাই জামায়াতের নির্বাচনি কৌশল হলো মাইনাস ফর্মুলা।
অন্যদিকে বিএনপি প্লাস ফর্মুলা নিয়ে নির্বাচনি মাঠে। অংশগ্রহণমূলক অন্তর্ভুক্তির গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই বিএনপির মূল লক্ষ্য। এ জন্য বিএনপি একদিকে সমমনাদের সঙ্গে নির্বাচনি ঐক্যের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে, নির্বাচনে জয়ী হলে সবাই মিলে সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিএনপির প্লাস রাজনীতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ছোট দলগুলোর প্রতিও তারা সমান সম্মান এবং গুরুত্ব দিচ্ছে। ১৬ বছরের পথের সাথীদের নিয়েই বিএনপি চলতে চায়। বিএনপি রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে চায়। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিকবার, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুসম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মুখ দেখাদেখি যেন বন্ধ না হয়’। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, আদর্শের লড়াই হবে, কিন্তু তা যেন শিষ্টাচারের মধ্যে থাকে। প্রতিপক্ষকে দমন, নির্মূলের রাজনীতি থেকে বিএনপি বাংলাদেশকে বের করে আনতে চায়। কিন্তু বিএনপির এই প্লাস রাজনীতি দুই কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথমত, লাগামহীন তৃণমূল। কিছু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বিএনপি কর্মীর দায়িত্বহীন আচরণ সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে। তাদের কারণে জনগণের মধ্যে বিএনপির ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি ইনোভেশন জরিপেও দেখা গেছে, গত মার্চের তুলনায় বিএনপির জনপ্রিয়তা সামান্য হলেও কমেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কথা তৃণমূলে ঠিকঠাক মতো যাচ্ছে না। আবার বিএনপির বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা পরিকল্পিত অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই প্রচারণা জনগণকে কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করছে। বিএনপি নিজেদের পরিকল্পনা সম্পর্কে বলার চেয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে বেশি ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। জামায়াত কৌশলে বিএনপিকে প্রচারণায় ব্যাকফুটে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, রাজনীতির মাঠে জামায়াত বারবার গোলপোস্ট বদল করে বিএনপির ইতিবাচক কর্মসূচি প্রচার করতে দিচ্ছে না। এখন বিএনপি তার ৩১ দফা নিয়ে প্রচারের চেয়ে পিআর পদ্ধতি, সংবিধান সুরক্ষা, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মতো ইস্যু নিয়ে বাধ্য হয়ে বেশি কথা বলছে। ৩১ দফাই যে রাষ্ট্র সংস্কারের চাবি, এই দলিল যে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি, তা কৌশলে আড়াল করা হচ্ছে। মাইনাস রাজনীতির বিপরীতে বিএনপি যত দ্রুত তার ইতিবাচক বা প্লাস রাজনীতি সামনে আনতে পারবে ততই তাদের জন্য ইতিবাচক হবে। মাইনাস-প্লাসের এই রাজনৈতিক কৌশলই হবে আগামী নির্বাচনের মূল উপজীব্য।
তবে প্রধান দুই দলের প্লাস-মাইনাসের রাজনৈতিক কৌশলের পাশাপাশি আরও দুটি মাইনাস কৌশল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সক্রিয়। এর মধ্যে একটি মাইনাস কৌশল দেশে বিরাজনীতিকীকরণে তৎপর। তারা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে চায়। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন যাতে না হয় সেজন্য তারা রাজনৈতিক বিভক্তির দিকে মনোযোগী। এদের নেতৃত্বে আছে সুশীল সমাজের একাংশ, যারা ২০০৭ সালের অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার মূল কুশীলব। যেহেতু বিএনপি এখন বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দল, তাই বিএনপিকে মাইনাস করতে পারলেই এদেশে দীর্ঘদিন অনির্বাচিত সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, বলে তারা মনে করে। আর এ কারণেই চলছে বিএনপির বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার। বিএনপির একাধিক নেতা এই মাইনাস ষড়যন্ত্র নিয়ে এখন খোলাখুলি কথা বলছেন। আরেকটি মাইনাস ফর্মুলা নিয়ে মাঠে সচল হয়েছে পতিত স্বৈরাচার। যেহেতু তারা এখন নিষিদ্ধ, বর্তমান বাস্তবতায় তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। তারা এখন নির্বাচন বানচাল করতে মাঠে নেমেছে। কাজেই প্লাস-মাইনাসের এই রাজনীতির খেলায় কে জয়ী হয়, তার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। যদি প্লাস জয়ী হয়, তাহলে এদেশে সুস্থ গণতন্ত্র ফিরবে। আর মাইনাস জয়ী হলে জুলাই বিপ্লবের স্বপ্নগুলো মরে যাবে। আমরা আবার প্রবেশ করব অন্ধকার টানেলে।