নব্বই দশকের প্রজন্ম যারা তারাই বিষয়টি বেশি অনুভব করতে পারবেন। সে সময় দেশের একমাত্র টেলিভিশন বিটিভিতে সম্প্র্রচারিত সিনেমার মাঝখানে হঠাৎই বাজত মন ছুঁয়ে যাওয়া কোনো সুর- ‘তুমি তুমি শুধু অনুভবে তুমি আমার...’ অথবা ‘সুস্থ সুন্দর দাঁতের জন্য ফ্রেশজেল...’। এ ছাড়াও প্যাকেজ নাটক-ধারাবাহিক কিংবা বিদেশি ডাবিং সিরিয়ালের বিজ্ঞাপন বিরতিতে শোনা যেত মিষ্টি ভয়েসের কিছু জিঙ্গেল, তার সঙ্গে তারকা মডেলের লিপসিং। এর মধ্যে সবার মুখে মুখে এখনো ফিরে সুমনা হকের কণ্ঠে মেরিল বেবি লোশন সেই জিঙ্গেল ‘সোনা জাদু মণি লে...’। এই জিঙ্গেলটি এখনো সবাইকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। কখনো ভাবায়, কখনো হাসায়। এটি ছাড়াও সুমনা হকের গাওয়া কিছু কালজয়ী জিঙ্গেল হচ্ছে, ‘তুমি তুমি শুধু অনুভবে তুমি’ (মেরিল কোল্ড ক্রিম), ‘আ হা হা পাকিজা’ (পাকিজা প্রিন্ট শাড়ি), ‘রঙে রঙে কারুকাজে...’ (নন্দিনী প্রিন্ট শাড়ি), ‘আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা’ (অ্যাঙ্কর মিল্ক), ‘তুমি ছাড়া আমি যেন আমি নই’ (কিউট ট্যালকম), ‘অন্ধকারে পথ দেখাতে অলিম্পিক’ (অলিম্পিক ব্যাটারি), কী মিষ্টি মিষ্টি অপলক দৃষ্টি অপরূপ সুন্দর লাগছে’ (সুন্দরী প্রিন্ট শাড়ি), ‘ম্যানোলা মানে টলমল শিশিরে লাবণ্য (ম্যানোলা)। এ জিঙ্গেলগুলো শুধুই বিজ্ঞাপন ছিল না, এগুলো ছিল আমাদের শৈশবের সাউন্ডট্র্যাক। আর এ শব্দের পেছনে যিনি ছিলেন, তিনি সুমনা হক-এক নিঃশব্দ আলো, যিনি ‘জিঙ্গেল কুইন’ নামে জায়গা করে নিয়েছিলেন নব্বই দশকের বিজ্ঞাপন ভুবনে। সব মিলিয়ে ২ হাজারেরও বেশি বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তার কণ্ঠে যেন একরকম আত্মীয়তা ছিল শ্রোতার সঙ্গে, অচেনা হয়ে থেকেও চেনা হয়ে ওঠা।
সুমনা হকের যাত্রা শুরু ফুয়াদ নাসের বাবুর হাত ধরে। তার কণ্ঠ ছিল স্বতন্ত্র। বিশেষ করে ‘ফ্রেশজেল’র বিজ্ঞাপনে তার কণ্ঠে ‘সুস্থ সুন্দর দাঁতের জন্য’ এ কথাটা বলার সময় ‘দাঁত’ শব্দে নাসিক্যতার প্রভাবে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারটা ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। সুমনা হক স্মৃতিচারণায় বলেছেন, তার বাড়ির পাশের বাড়ির ব্যালকনিতে দুটি ছেলেমেয়েকে এ বিজ্ঞাপন নিয়ে কথা বলতে শুনেছিলেন। একজন ‘দাঁত’ শব্দটা সাধারণভাবে বলতে দেখে আরেকজন ভুল ধরিয়ে বলেছিল-‘না না ‘দাঁত’ এভাবে হবে না, হবে ‘দাঁত’ (নাসিক্যতা দেখিয়ে)।’ তখনকার বিজ্ঞাপনের ব্যাপ্তি খুব ছোট থাকত, কিন্তু সৃজনশীল হতো। অল্পের মধ্যে মন ছুঁয়ে যাওয়ার একটা আয়োজন থাকত। সুমনা হক যখন বিজ্ঞাপনে জিঙ্গেল দেওয়া শুরু করেন এমন জিঙ্গেলও দিয়েছেন যার কোনো স্ক্রিপ্ট ছিল না; জাস্ট উপস্থিত গিটার বাজিয়ে, পিয়ানো ধরে, তবলা বাজিয়ে একটা দলের চেষ্টায় বেরিয়ে আসত কিছু কথা আর সেটাকে জিঙ্গেল করা হতো। ঘরোয়া আড্ডার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসত সৃজনশীল বিজ্ঞাপনী জিঙ্গেল।
বিয়ন্ড দ্য জিঙ্গেল : গান, আবৃত্তি আর আঁকার জগৎ
সুমনা হক শুধু জিঙ্গেলেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তার ‘মায়াবী এ রাতে’ গানটি একসময় ফিলিংস, ভালোবাসা আর বিরহের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল। এ ছাড়াও ‘মাঝে কিছু বছর গেল’, ‘সজনী যেও না’, ‘আবার এলে ফিরে’ প্রভৃতি গান তার রোমান্টিক ও আবেগঘন গায়কির সাক্ষ্য দেয়। রবীন্দ্রসংগীতেও তার বিশেষ দক্ষতা ছিল-স্বকীয় আবহ, শান্ত গলা আর আবেগ মিশ্রণে গানে এনে দিতেন গভীরতা। চিত্রশিল্পেও তার অসাধারণ অবস্থান। ‘রংধনু’ নামের সলো এক্সিবিশনে প্রকৃতি ও আত্মপ্রকাশের মেলবন্ধন ছিল চোখে পড়ার মতো।
সৃষ্টির জন্য, জনপ্রিয়তার জন্য নয়
সুমনা হকের কাজের মধ্যে একটা মৌলিক ব্যাপার ছিল। তিনি ‘সৃষ্টি’র জন্য কাজ করতেন, জনপ্রিয়তার জন্য নয়। এ কারণেই হয়তো জিঙ্গেল আর গানের তুমুল ব্যস্ততার মাঝেও একসময় নিজেকে ধীরে সরিয়ে নেন মিডিয়া থেকে। এখন তিনি নিজের মতো করে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। চিত্রশিল্পের কাজেই তার মূল মনোযোগ।
একটি প্রজন্মের শ্রদ্ধাভাজন শিল্পী
সুমনার কাজ আমাদের শৈশব, কৈশোর আর স্মৃতির অ্যালবামে চিরকাল জায়গা করে নিয়েছে। তিনি আজ মিডিয়ার সামনে নেই, কিন্তু তার সৃষ্টিগুলো এখনো জীবিত- একটি প্রজন্মের অন্তরে, অবচেতনে। হয়তো পরবর্তী প্রজন্মেও তার সৃষ্টি স্থানান্তরিত হয়েছে। তিনি ছিলেন নেপথ্য নায়িকা। আলোতে না থেকেও, আলো ছড়ানোর মতো যার ছিল অফুরন্ত প্রাণশক্তি।