ড. ইউনূস সরকারের একজন উপদেষ্টার প্রেমে আমি এক বছর ধরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। ভদ্রলোক উপদেষ্টা হওয়ার পূর্বে ফেসবুকে বেশ সক্রিয় ছিলেন এবং আমার সঙ্গে বন্ধু তালিকায় যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোতে নিয়মিত লিখতেন। তাঁর কয়েকটি নিবন্ধ পড়েছিলাম। সেগুলোর মধ্যে প্রয়াত জামায়াত নেতা শাহ আবদুল হান্নানকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি আমাকে নিদারুণভাবে মোহিত করেছিল। ফলে তিনি যেদিন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারূপে শপথ নিলেন তখন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সম্পর্কে আমি ভীষণ আশাবাদী হয়ে উঠলাম। পরে যখন দেখলাম তিনি বৃহত্তর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, খনিজ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন তখন আমার আশাবাদের পরিধি বেড়ে গেল।
আমি বৃহত্তর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য এবং একই কমিটির তিনটি সাবকমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। অন্যদিকে বিদ্যুৎ-খনিজ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সম্পর্কেও আমার জানাশোনা কম ছিল না। কারণ আমার নির্বাচনি এলাকায় মার্কিন কোম্পানি শেভরন তেল-গ্যাসের একটি কূপ খনন করছিল, যা নিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে যে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয় তা সামাল দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যে উচ্চপর্যায়ের কমিটি হয় সেখানে আমি ছিলাম মেম্বার সেক্রেটারি। ফলে মন্ত্রী-সচিব-জেলা প্রশাসকসহ গোয়েন্দা কর্তাদের পাশাপাশি শেভরনের কর্তা ও মার্কিন দূতাবাস কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ হয়েছিল। ফলে ফাওজুল কবির খানের মন্ত্রণালয়গুলোর অনেক কিছুই আমার মুখস্থ।
আমি জানি উল্লেখিত মন্ত্রণালয়গুলোর দুর্নীতি, অনিয়ম এবং একই সঙ্গে ভালো কাজ করার অবারিত সুযোগ সম্পর্কে। সুতরাং দায়িত্ব লাভের পর জনাব কবির যেভাবে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলছিলেন তা শুনে আমার কান শীতল হতে আরম্ভ করল। তাঁকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখলে আমার নয়ন জুড়িয়ে যেত এবং হৃদয়ে প্রশান্তি চলে আসত। কারণ আমি জানি যে ফাওজুল কবিরের একটি সিদ্ধান্তই দেশের সড়ক মেরামতের জন্য যথেষ্ট অথবা বিদ্যুতের লোডশেডিং কমানোর যে ম্যানেজমেন্ট তা মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তার দক্ষতা-অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে।
আমি গত চার-পাঁচ বছর ঢাকার বাইরে যাইনি। ফলে ঢাকার রাস্তাঘাটে এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ দেখে মনে হচ্ছিল যে এক বছর ধরে জনাব কবির তাঁর মন্ত্রণালয় অসাধারণভাবে চালাচ্ছেন। কিন্তু কয়েক দিন আগে টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার গহিনের একটি রিসোর্টে সপরিবার বেড়াতে গিয়ে যে দুর্ভোগ-দুর্দশায় পড়েছিলাম এবং যেভাবে অসুস্থ হয়ে ঢাকায় ফিরতে বাধ্য হলাম তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে আজকের নিবন্ধের অন্য প্রসঙ্গে চলে যাব। আপনি যদি ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল চলে যেতে চান তবে সবচেয়ে সহজ রাস্তা হলো সাভারের নবীনগর হয়ে ইপিজেড সড়ক দিয়ে বিকেএসপি পার হয়ে টাঙ্গাইল মহাসড়কে পৌঁছানো।
১৯৮৬ সাল থেকে নিয়মিত ঢাকা থেকে বিকেএসপি যাতায়াত করে আসছি। বিশেষ করে নতুন ইপিজেডসংলগ্ন মেইন রোডে আমার একটি কম্পোজিট টেক্সটাইল থাকায় আমি সপ্তাহে তিন-চার দিন টানা দশ বছর ওই পথের যাত্রী ছিলাম। ফলে আমার চব্বিশ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে দিব্যি করে বলতে পারি যে নবীনগর-ইপিজেড সড়কের নবীনগর অংশের সাভার ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড থেকে বাইপাইল মোড় এবং সেখান থেকে বিকেএসপি পর্যন্ত রাস্তার যে বেহাল দেখলাম তা অতীতে কখনো কল্পনাও করা যেত না। আমি পৃথিবীর অনেক অনুন্নত এবং কয়েকটি অসভ্য দেশও ভ্রমণ করেছি কিন্তু ফাওজুল কবিরের মন্ত্রণালয়ের অধীন এমন অসভ্য সড়ক কোথাও দেখিনি। অথচ মাত্র তিন-চার কোটি টাকার মেরামত করলে দৈনিক শত শত কোটি টাকার জাতীয় ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।
উল্লেখিত রাস্তার দুরবস্থার সামান্য কিছু চিত্র বর্ণনা করছি। সংশ্লিষ্ট রাস্তায় দিনরাত ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম লেগে থাকে। রাস্তার ওপর অসমাপ্ত এক্সপ্রেসওয়ের কাজ বন্ধ রয়েছে। নিচে খানাখন্দ ধুলোবালি, ব্যারিকেড, মলমূত্র, লোকজনের খিস্তিখেউর, গালাগাল, হইচই এবং যানবাহনগুলোর গুতোগুতি। ড্রাইভার-হেলপারদের মারামারি এবং মাঝেমধ্যে গাড়ি বিকল হয়ে যাওয়াসহ যেসব বিপত্তি ঘটে তা একত্র করলে একটা বড় বড় জাহান্নাম হয়ে যাবে। ওই রাস্তায় গর্ভবতীর গর্ভপাত ঘটে বয়স্ক লোকেরা হেগেমুতে একাকার করে ফেলে শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমার রোগীরা জ্ঞান হারায়। অ্যালার্জির রোগীরা নিজের শরীর চুলকাতে চুলকাতে রক্ত বের করে ফেলে এবং সুস্থসবল মানুষেরা মাথাব্যথায় আক্রান্ত হয়ে যেভাবে বমি করে দেয় তার কিছু নমুনা সংগ্রহ করে যদি মন্ত্রণালয় কর্তাদের টেবিলে, শোয়ার রুমে অথবা তারা যখন খোশগল্পে মেতে ওঠেন তখন পরিবেশন করতে পারতাম, তবে আমার দুঃখ কিছুটা হলেও কমত।
রাস্তার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এবার বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক। আমরা যে রিসোর্টে ছিলাম সেটি সখীপুর উপজেলার গহিন অরণ্যের মধ্যে এক শ বিঘা জমির ওপর নির্মিত। কক্সবাজারের বিখ্যাত পাঁচ তারকা হোটেল সিগ্যাল কর্তৃপক্ষ সিগ্যাল ভিলেজ নামে বিশাল এই পাঁচ তারকা মানের রিসোর্টটি নির্মাণ করতে গিয়ে কত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পর্যটকদের বিনোদন ও আরামদায়ক অবস্থানে কোনো ত্রুটি তাদের নেই। কিন্তু ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে তারা যে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে তা সামাল দিতে না পারলে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে যাবে। আমি যে কদিন সেখানে ছিলাম সেই সময়ে দৈনিক ২৩-২৪ বার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করত। দিনরাতের চার ভাগের তিন ভাগ সময় জেনারেটর চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাটে লাইট-ফ্যান-এসি-টিভি-ফ্রিজসহ স্বয়ংক্রিয় জেনারেটরগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। অতিথিরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন এবং রেস্টুরেন্টের ফ্রিজগুলোতে রক্ষিত খাবারদাবার নষ্ট হয়ে যায়। সেখানকার মালিক-কর্মচারীদের মধ্যে যে হতাশা, তা দেখার পর আমার পুরো ভ্রমণটিই মাটি হয়ে যায়। রিসোর্টটিতে ৭৫টি পাঁচ তারকা মানের রুম রয়েছে। আমি যেদিন গেলাম সেদিন পুরো রিসোর্টে আমি একাই মেহমান ছিলাম। অথচ আমাকে সেবা দেওয়ার জন্য ৯০ জন নিয়মিত স্টাফ নিয়োজিত ছিলেন। সেখানে থাকার সময় আমার বারবার মনে হয়েছে- ইস! মাননীয় উপদেষ্টা যদি আমার ভ্রমণসঙ্গী হতেন এবং রিসোর্টে যদি আমরা পাশাপাশি কামরায় থাকতে পারতাম তাহলে ওনার অসিলায় হয়তো দিনে একবারও লোডশেডিং হতো না।
আমি যে কদিন সখীপুরে ছিলাম সে কদিন সকাল-বিকালে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছি। কখনো গহিন অরণ্যের মাঝে কোনো গৃহস্থের ঘরে আবার বিলের মধ্যে আপন মনে শাপলা তুলতে ব্যস্ত সত্তরোর্ধ্ব অভাবী বৃদ্ধদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভাব-অভিযোগ, রাজনীতি, ভোট, নির্বাচন- আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত নিয়ে কথা বলেছি। বিলের মধ্যে সকাল থেকে রাত অবধি একটি ছইবিহীন ডিঙি নৌকায় ভেসে যে জেলে মাছ ধরছিলেন তার সঙ্গে কথা বলেছি। বনের মধ্যে ছোট্ট মাঠে কিশোরেরা ফুটবল খেলছে রাস্তায় কয়েকটি পাগল, কয়েকজন অটিস্টিক কিশোর এবং স্কুলগামী বালক-বালিকাদের বেশভূষা দেখে অনুধাবনের চেষ্টা করেছি- দেশটা আসলে কোথায় যাচ্ছে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয়েছে- অভাব অভিযোগ-হতাশা-ক্ষোভ ও বঞ্চনার নতুন ইতিহাস আমাদের ভয়ংকর পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আমি কয়েকজন স্থানীয় বয়স্ক নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বললাম। পিআর পদ্ধতি, জামায়াত-বিএনপি-এনসিপি বা ড. ইউনূস সম্পর্কে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। পুরো এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করেন যাদের বেশির ভাগই দরিদ্র। মুসলমানরাও দরিদ্র কিন্তু তাদের হতাশা ও ক্ষোভ হিন্দুদের চেয়ে বেশি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, পুরো এলাকার মানুষ গোপালগঞ্জের মতোই আওয়ামী লীগ ভক্ত। সেখানকার সাধারণ মানুষ নেতা বলতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, সাবেক প্রয়াত এমপি শওকত মোমেন শাহজাহানকেই চেনেন। রিসোর্টের তিন-চার বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় মানুষই জানে না- ভবিষ্যতে বিএনপির মনোনয়ন কে পাবে এবং আরও অবাক করার বিষয় হলো তাদের কেউই বিএনপির এমপি প্রার্থীদের নাম জানে না। আমি বেশ কয়েকজনকে বিএনপির প্রার্থীদের সম্পর্কে বারবার জিজ্ঞাসা করলে একজন মুরুব্বি বিরক্তি নিয়ে বললেন, সখীপুরে কেউ নেই শুনেছি বাসাইল থেকে একজন দাঁড়াবে। এই যদি হয় আওয়ামী লীগ-অধ্যুষিত প্রত্যন্ত দুই-তিনটি ইউনিয়নে বিএনপির দশা তবে সেখানে জামায়াত-এনসিপি বা ড. ইউনূসের কি দশা তা অনুধাবনের জন্য খুব বেশি পাণ্ডিত্যের দরকার নেই।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক