ইসলাম কল্যাণের ধর্ম। আমরা বুঝি বা না বুঝি, ইসলামের প্রতিটি নির্দেশ ও বিধানেই রয়েছে কল্যাণ। রসুল (সা.) আমাদের কল্যাণময় জীবনের প্রতি পথনির্দেশ করেছেন। আমরা যদি তাঁর নির্দেশিত পথে জীবনযাপন করি, পরকালে তো বটেই, ইহকালেও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারব। সুন্নাহসম্মত জীবনযাপনের উপকারিতা আজকের বিজ্ঞানও স্বীকার করতে বাধ্য। আজ আমরা জীবনযাপনের এমন কিছু সুন্নাহ সম্পর্কে আলোচনা করব, যার মাঝে রয়েছে ইহকাল ও পরকাল, উভয় জগতের কল্যাণ।
এক. পরিমিত খাবার গ্রহণ। খাবারে পরিমিতি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। পেটভরে খাওয়া উচিত নয়। রসুল (সা.) অতিভোজন পছন্দ করতেন না। তিনি বলেন, দুনিয়াতে অধিক ভোজনকারীরা কিয়ামতের দিন ক্ষুধার্ত থাকবে (ইবনে মাজাহ)। অন্য হাদিসে তিনি বলেন, মুমিন এক পেটে আহার করে আর কাফির সাত পেটে খায় (বুখারি)। দুই. স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ। অতিভোজনের পাশাপাশি বর্তমানে আমাদের অসুস্থতার প্রধান কারণ অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ। স্বাস্থ্যকর খাবারের চেয়ে মুখরোচক খাবারের দিকেই আমাদের ঝোঁক বেশি। ভাজাপোড়া, কোল্ড ড্রিঙ্কস আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। অথচ রসুল (সা.) এমন খাবার পছন্দ করতেন, যেগুলোর মাঝে রয়েছে উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ। যেমন : খেজুর, দুধ, মধু, লাউ ইত্যাদি। বর্তমান সময়ের অনেক বড় শারীরিক সমস্যার নাম স্থূলতা। এই স্থূলতার পেছনে আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর ও অপরিমিত খাবার প্রধানত দায়ী। তাই সুস্থ থাকতে খাবার গ্রহণের সুন্নতের প্রতি আমাদের বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। তিন. রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো। মহান আল্লাহ বিশ্রাম বা ঘুমানোর জন্য রাত দিয়েছেন এবং কাজ করার জন্য দিন দিয়েছেন। দিনের সময়টুকু শতভাগ ব্যবহার করতে হলে আমাদের রাতে দ্রুত ঘুমাতে হবে। তাড়াতাড়ি ঘুমানো রসুল (সা.)-এর সুন্নাহ ও অভ্যাস। হাদিসে এসেছে, রসুল (সা.) এশার পূর্বে ঘুমানো এবং এশার পরে কথাবার্তা বলা অপছন্দ করতেন (বুখারি)। চার. ফজরের পর না ঘুমানো। রসুল (সা.) সকালে ঘুমাতেন না। যারা সকালে না ঘুমিয়ে কাজ করে, তাদের জন্য তিনি বারাকাহর দোয়া করেছেন। তিনি বলেছেন, হে আল্লাহ! আমার উম্মতের সকালসমূহে বারাকাহ দিন (আবু দাউদ)। অথচ এই বরকতপূর্ণ সময়টাই আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। যারা ফজরের সালাত আদায় করে না তারা তো বটেই, যারা সালাত আদায় করে তারাও নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দাওয়াহর কাজে মুসলিম-প্রধান অমুসলিম-প্রধান নানা দেশে সফর করার সুযোগ হয়েছে আমার। অবাক করা বিষয় হলো, অমুসলিম-প্রধান দেশগুলোতে রসুল (সা.)-এর এই সুন্নতের ওপর আমল করার প্রবণতা দেখেছি সবচেয়ে বেশি। আর এ বিষয়ে মুসলমানদের মাঝে সবচেয়ে বেশি অবহেলা দেখেছি। আমি বলছি না, অমুসলিমরা রসুল (সা.)-এর জীবন থেকে এই আমল। হয়তো কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে। কিন্তু তাদের জাগতিক উন্নতির পেছনে এই লাইফস্টাইলের বিরাট ভূমিকা আছে বলে মনে হয়। কারণ আপনি যদি রাত ৯টার ভিতর ঘুমিয়ে পড়েন, সারা রাত ঘুমান, ভোরে আপনি প্রাণবন্ত ও সজীব হয়ে বিছানা থেকে উঠবেন। এরপর যে কাজ করবেন, সেই কাজ হবে কোয়ালিটিপূর্ণ। অথচ আমাদের রাত শুরু হয় ১০টায়। এরপর ঘুমাতে ঘুমাতে ১২টা-১টা বেজে যায়। এত বিলম্বে ঘুমালে স্বাভাবিকভাবেই ভোরে আপনার ঘুম পাবে। এরপর আপনার দিন শুরু হবে সকাল ১০টায়। আপনি এখানেই ওদের থেকে পিছিয়ে গেলেন। পাঁচ. নফল রোজা। রমজানের ফরজ রোজা তো আমরা রাখবই, এ ছাড়া সারা বছর আমাদের নফল রোজাও রাখতে হবে। এতে একদিকে আমরা যেমন রোজার সওয়াব পাব, পাশাপাশি উপবাস থাকার কারণে আমরা সুস্থ থাকব। চিকিৎসকরাও বলছেন, মাঝেমধ্যে উপবাস থাকা শরীরের জন্য উপকারী। শুরুতে অতিভোজনের অপকারিতার কথা বলেছি। খাবার সামনে এলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এ ক্ষেত্রে রোজা হতে পারে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অন্যতম মাধ্যম।
ছয়. মেসওয়াক। মেসওয়াক করা রসুল (সা.)-এর প্রিয় আমল। তাঁর জীবনের শেষ আমল ছিল মেসওয়াক। মেসওয়াক করলে আমরা রসুলের সুন্নতের ওপর আমল করার সওয়াব পাব। আবার এর ফলে আমাদের মুখের দুর্গন্ধ দূর হবে, দাঁত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত থাকবে। সাত. পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। পবিত্র থাকা এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। রসুল (সা.) সব সময় পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি যত্নবান থাকতেন। প্রস্রাব-পায়খানা করার পর তিনি পানি ব্যবহার করতেন। খাবার আগে-পরে হাত ধুতেন। নিয়মিত চুল আঁচড়াতেন। সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। আবার তিনি খাবারের পাত্র ঢেকে রাখতে এবং ঘুমানোর আগে বাতি নিভিয়ে দিতে বলেছেন। এসবই মানবজীবনের পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও সতর্কতার শিক্ষা। রসুল (সা.)-এর প্রতিটি সুন্নাহই মানবজীবনের জন্য উপকারী। আমরা যদি দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হতে চাই, যদি একটি সুন্দর, পরিশীলিত, স্বাস্থ্যকর জীবন চাই, তবে রসুল (সা.)-এর এই লাইফস্টাইলভিত্তিক সুন্নতের ওপর আমল করার বিকল্প নেই।
জুমার মিম্বর থেকে বয়ান
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ