ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটা টাইমফ্রেম পাওয়া গেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রোজার আগে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি বোধগম্য কারণেই এ ঘোষণায় খুশি। নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টাকে তাঁর অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে পারা নিঃসন্দেহে দলটির কৌশলগত বিজয়। বিএনপির মিত্র দলগুলোও নির্বাচনের সময়-সংকেত পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। জামায়াতে ইসলামী মনে হয় দম নিচ্ছে। স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। এই ইসলামিক দলটির নীতি-কৌশলের খোঁজখবর যারা রাখেন তাদের অনেকে বলছেন, কিছুটা মুলামুলি করে শেষমেশ তারা অবস্থান বদলাবে। নির্বাচনের মাঠে সর্বশক্তি নিয়ে নেমে পড়বে। সব আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার কোশেশ করবে। সেই প্রস্তুতিও জামায়াতে ইসলামীর রয়েছে। এখনই তাদের ২৮৮টি আসনে শুনেছি প্রার্থী তৈরি। ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে ও ময়দানে যেরূপ বয়ানই দিয়ে থাকুন না কেন, গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় পুরোদমে ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে জামায়াত বিএনপির থেকে অনেকটাই এগিয়ে।
প্রসঙ্গত ইতিহাসের আলোকে জামায়াতে ইসলামী কত দ্রুত কৌশল বদলাতে পারে তার দুয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানালেও গণহত্যা শুরু হলে জামায়াত কী ভূমিকা নিয়েছিল তা কমবেশি সবাই জানে। এরশাদ জমানায় জামায়াত আন্দোলনে ছিল। সামরিক শাসক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিলে আন্দোলনকারী দল ও জোটের সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি দিয়ে রাজপথেও ছিল। আন্দোলনরত দলগুলো বলছিল যে সামরিক শাসনের অধীনে তারা কোনো ইলেকশনে যাবে না। জামায়াতে ইসলামী ছিল আরও এককাঠি সরেস। তারা কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছিল। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন (আন্দোলনের) পিঠে ছুরিকাঘাত করে মধ্যরাতে শেখ হাসিনা এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে জামায়াতে ইসলামীও অবস্থান বদলে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং ১০টি আসনে জয়লাভ করে।
নব্বই দশকেও জামায়াত একাধিকবার অবস্থান পরিবর্তন করে। ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করে। আবার ২০০১ সালে এসে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করে। সেবার জামায়াত ১৭টি আসন পায়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারে জামায়াতের মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রিত্ব লাভ করেন।
তাঁদের গাড়িতে ওঠে জাতীয় পতাকা। বিষয়টি আওয়ামী লীগ ও সমমনা রাজনৈতিক সমাজ এবং ‘প্রগতিশীল’ মহলে নিন্দিত হয়। যদিও নির্বাচন অ্যালায়েন্সটি ছিল চারদলীয় জোট, তথাপি আওয়ামী লীগের লোকেরা তখনকার সরকারের নাম দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। বিএনপি ২০০১ সালের নির্বাচনে ১৯৩টি আসন পেয়েছিল। সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ১৫১টি আসন। বিএনপি একাই সরকার গঠন করতে পারত। তা সত্ত্বেও জোটের নৈতিক দাবির প্রতি কমিটমেন্ট রাখতে গিয়েই হয়তো মন্ত্রিসভায় জামায়াতের দুজনকে জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। সেটা করে বিএনপির কতটা লাভ বা ক্ষতি হয়েছিল সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
যা-ই হোক জামায়াতের অবস্থান এখন জাতীয়তাবাদী দলের বিপরীতে। এতে বোঝা যায়, জামায়াতে ইসলামী সময় বুঝে অবস্থান বদলাতে বিলম্ব করে না। দলটি ঘন ঘন কৌশল পরিবর্তন করে। হতে পারে এটা তাদের রণকৌশল। সুতরাং বলাই যায়, জামায়াত নির্বাচনে আসবে তা প্রায় নিশ্চিত। সংবাদ সম্মেলন করে সেই ইঙ্গিত ইতোমধ্যে তারা দিয়েছেও। বস্তুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লাই হবে ধানের শীষের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
এনসিপি কী করবে? এখনো নবীন এই দলটির নিবন্ধন হয়নি। মার্কাও নেই। দলের প্রধান ছিলেন জুলাই ঘোষণার মঞ্চে। কিন্তু সম্মুুখসারির কয়েকজন নেতা ছিলেন সমুদ্রবিলাসে। এ নিয়ে অনেক গুঞ্জন, অনেক কথা! তাঁরা নাকি সাগরপাড়ে গিয়েছিলেন পিটার হাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কোনো কোনো পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে কিন্তু পিটার হাস তখন ওয়াশিংটনে ছিলেন। তাহলে গুঞ্জন উঠল কেন? মি. হাস বাংলাদেশে তসরিফ এনেছেন কি আনেননি সে বিষয় ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসও কিছু বলেনি, যদিও বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে- মি. হাসের সঙ্গে দূতাবাসের কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি এখন বেসরকারি লোক। বেশ তো! তাহলে দূতাবাসের এরকম একটা বিবৃতি দেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন? তাহলে কি ডাল মে কুচ কালা হ্যায়! কে জানে, আল্লাহ মালুম।
এনসিপির এক নেতা জুলাই ঘোষণার রাতেই তাৎক্ষণিক জানিয়েছিলেন যে তারা নির্বাচন নিয়ে এখনই কিছু ভাবছেন না। পরে গত বুধবার দলটি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের যে সময় ঘোষণা করেছেন, এনসিপির তাতে কোনো আপত্তি নেই। তবে শর্ত আছে, এনসিপির শর্তগুলো জামায়াতের পূর্ব শর্তগুলোর প্রায় অনুরূপ। জুলাই ঘোষণাপত্রের অপূর্ণতার অনুযোগ করে জামায়াত যে বিষয়গুলোর কথা বলেছে এনসিপিও একই রকম বলেছে। এটা হতে পারে কাকতালীয় অথবা রাজনৈতিক আত্মীয়তার সূত্রেও। সময়ই সব বলে দেবে। ছোট-বড় সব রসুনের ঝাঁজ একই রকম হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় এনসিপি নির্বাচন প্রশ্নে কী কৌশল অবলম্বন করে তা বেশ একটা কৌতূহলের বিষয়। দলটির অস্তিত্বের সংকটও দেখা দিতে পারে।
মাঠে যখন আওয়ামী লীগ নেই তখন বিএনপির হালফিল জনসমর্থন যে সবচেয়ে বেশি তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। তার চেয়েও বড় কথা, বৃহত্তম এ দলের দায়দায়িত্বও এখন অনেক বেশি। এ দলের কাছে গণতন্ত্র ও শান্তিকামী মানুষের দাবি এবং প্রত্যাশাও অনেক। সেদিন এ কথাটিই বললেন আমার পরিচিত বিদগ্ধ একজন ট্রেড ইউনিস্ট, যিনি এখন রিটায়ার্ড। তাঁর মতে, বিএনপি বাধা না দিলে এই এক বছরে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যেত। ১৯৭১ সাল যে জাতীয় জীবনে এসেছিল, সেই সত্যটিই হয়তো ভুলিয়ে দেওয়া হতো। প্রকট হয়ে দেখা দিত সাংবিধানিক সংকট। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ইস্যু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেত। যারা বুলডোজার দিয়ে ৩২ ভেঙেছে, যারা জাতীয় সংগীত বদলাতে চেয়েছে, যারা বিনা ভোটে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার রসনা ও বাসনা পোষণ করেছে, তাদের সামলানো যেত না বিএনপি না থাকলে। কার্যত বিএনপির নেতৃত্ব এবার ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করেছে, যদিও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অনেকেই চলেছে গড্ডলিকা প্রবাহে। এ বাস্তবতায় বিএনপির কাছে মানুষের অনেক দাবি ও প্রত্যাশা। আরেকজন অশীতিপর বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে, শান্তি আসবে কি না, তা এখন নির্ভর করছে বিএনপির ওপর।
বিএনপি বড় দল। সমস্যাও কিন্তু তার অনেক। প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় দলের মধ্যে দলাদলি আছে কমবেশি। একশ্রেণির অপরিণামদর্শী ও নীতিবিবর্জিত নেতা-কর্মীর মধ্যে খাই খাই ভাবটা প্রবল। এ খানেওয়ালা নেতা-কর্মীদের মধ্যে যারা অতিমাত্রায় চাঁদাবাজি, খুনাখুনি, মবোক্র্যাসি করে সামাজিক ও গণমাধ্যমে খবর তৈরি করেছে বিএনপি তৎক্ষণাৎ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ওদের ধরতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে। কিন্তু বিএনপি সরকারে নেই। প্রশাসন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিএনপির সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত আমলে নেয়নি বা নিচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে ‘উহাদের’ সঙ্গে দহরমমহরম ছিল এবং আছে। সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে লোকপ্রচার রয়েছে এরকমই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেও এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
দৃষ্টিগ্রাহ্য ক্রাইম করে যারা দলের নজরে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে কেবল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে; কিন্তু পাড়ায়-মহল্লায়, গ্রাম ও শহরতলির নানান স্পটে দলের নাম ভাঙিয়ে ছোটমাপের যেসব পাতিনেতা মানুষের ওপর জুলুম করছে তাদের খবর অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। কেউ একটা ঘর তুলছে, জমি বিক্রি করছে, ছোট ব্যবসা করছে, সেখানেও এরা চাঁদা আনতে যায়। বালুমহালে, ইটের ভাটায়, রিকশাস্ট্যান্ডে এরা চাঁদাবাজি করে। এদের সবাই যে বিএনপির, তা অবশ্য নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নামধারীও আছে। অন্যান্য দলেরও আছে। কিন্তু বিএনপিরটাই চোখে পড়ে বেশি।
কারণ দল বড়। কর্মীও বেশি। সংখ্যায় যারা বেশি সবকিছুতেই তারা বেশি। এমতাবস্থায় পাড়া-মহল্লার ক্ষুদ্র চাঁদাবাজদেরও দমন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পচা ও গুঁড়া শামুকে পা বেশি কাটে। গ্রামের মানুষ আড়চোখে এদের দেখছে এবং বুকের মধ্যে লিখে রাখছে। ব্যালটে জবাব দেবে। কাজেই খুদে চান্দাবাজদেরও সামলাতে হবে। উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের এ বিষয়ে সতর্ক করতে হবে। তারা যেন তাদের দুষ্ট কর্মীদের প্রশ্রয় না দেয়। মনে রাখা জরুরি, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ভোটের কারবারে চাঁদাবাজ- ধড়িবাজরা মূল্যহীন। ওরা বরং ভোট নষ্ট করবে। ভবিষ্যতেও ওরা সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করবে। কাজেই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের এখনই সময়। ওদের সামলাতে হবে দল ও দেশের স্বার্থে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক