বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে এস এম সুলতান এক অবিস্মরণীয় নাম। একাধারে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী এক শিল্পী, অন্যদিকে এক নির্লোভ সাধক, যিনি শিল্পকে কখনোই পণ্যে রূপ দেননি। তিনি ছিলেন লোকজ ঐতিহ্য, কৃষি, প্রকৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের শিল্পদর্শনের প্রতিভূ। তাঁর তুলির টানে যেমন ধরা দিয়েছে বাংলার সজীব মাটি, তেমনি উচ্চারিত হয়েছে বাংলার কৃষকের মহিমা ও মর্যাদা।
গত এপ্রিলে শিল্পী এস এম সুলতানের জন্মভিটা নড়াইল শহরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ভাবলাম শিল্পী এস এম সুলতান সংগ্রহশালাটা দেখে যাই। শিল্পীর ভাবনার জায়গাটাতে নিজের ভাবনার মিল খুঁজে পাই। চল্লিশ বছরের বেশি সময় যে ছুটে চলেছি গ্রাম থেকে গ্রামে, কৃষকের কাছ থেকে আরেক কৃষকের কাছে, এই কাজটা করছি, আমার নিজস্ব একটা স্বপ্ন আছে, একটা ইচ্ছে আছে। শিল্পী এস এম সুলতানের মতো আমিও চেয়েছি দেশের কৃষকরা হোক সবচেয়ে বলবান, তাঁদের পেশিতে থাকুক তাবৎ শক্তি। টিকে থাকার প্রশ্নে দেশে কৃষকের লড়াইটাই তো সবচেয়ে বেশি।
যাই হোক, শিল্পী এস এম সুলতান সংগ্রহশালায় পৌঁছাতেই সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন কিউরেটর তন্দ্রা মুখার্জি। সদাহাস্য এক তরুণী। জানালেন তিনি নিজেও ছিলেন সুলতানের ছাত্রী। তিনি পরিচয় করিয়ে দেন সুলতানের শিল্পের অন্তর্নিহিত ভাবের সঙ্গে। বলেন, সুলতানের ছবিগুলোতে এমন সব দিক উঠে আসে, যা সাধারণ চোখে দেখা যায় না। যেমন- প্রকৃতির নিঃশব্দ ভাষা, মানুষের অব্যক্ত সংগ্রাম ও জীবনধারার গভীর রূপান্তর।
১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট, নড়াইল জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মোহাম্মদ সুলতান। গ্রামের মানুষ তাঁকে ডাকত লাল মিয়া নামে। দরিদ্র কৃষক পরিবারের এই সন্তান ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকায় ডুবে থাকতেন। তাঁর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চিত্রা নদীর সৌন্দর্য আর গ্রামীণ জীবনের প্রাণময়তা ছোট্ট লাল মিয়ার মনে এমন দাগ কেটে দেয়, যা পরবর্তী জীবনে ক্যানভাসে ছাপ ফেলেছিল গভীরভাবে। প্রথাগত শিক্ষায় সুলতান কখনোই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেও তিনি সার্টিফিকেটের চেয়ে জীবনের অভিজ্ঞতাকে বেশি মূল্য দেন। পরবর্তী জীবনে ভারত, ইরান, ইরাক, কুয়েত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু সব ভ্রমণ শেষে তিনি ফিরে এসেছেন নিজের মাটিতে, নড়াইলে।
এস এম সুলতান ছিলেন আপনভোলা এক শিল্পী। চিত্রা নদীর তীরঘেঁষা পুরুলিয়া গ্রামে নিমগ্ন থাকতে চেয়েছেন আজীবন। থাকতে চাননি আলোচনায় বা চাননি তাঁকে নিয়ে মাতামাতি হোক। আপন জগৎ নিয়েই তিনি থাকতে চেয়েছেন। অপূর্ব বাঁশি বাজাতেন। বাজাতেন তবলা। বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় যখন তাঁকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ সম্মাননা প্রদান করল তখনো তিনি বললেন, ‘শিল্পের কখনো পুরস্কার হয় না। শিল্পের ভার তো প্রকৃতি স্বীয় হাতে প্রদান করে।’ সংগ্রহশালায় ২৩টি মূল ছবি রাখা আছে। আর ৫৪টি রেপ্লিকা রাখা হয়েছে সংগ্রহশালার বাইরের দেয়ালে। সুলতানের ক্যানভাসে প্রধান চরিত্র ছিল বাংলার কৃষক, যে কৃষক তাঁর বাস্তব জীবনে রুগ্ণ, ক্লান্ত ও সংগ্রামী। তাঁকে তিনি রূপ দিয়েছেন এক গৌরবময়, বলিষ্ঠ, পেশিবহুল মানবদেহে। তাঁর ভাষায়, ‘আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহ এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ন কেন- যাঁরা আমাদের অন্ন জোগায়। ফসল ফলায়।’
এই প্রশ্ন তাঁর শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলার কৃষক শুধুই চাষাবাদকারী নন, বরং জাতির মেরুদণ্ড। তাঁর তুলির মাধ্যমে তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, দেশের সম্পদ উৎপাদনের পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁরা মর্যাদা ও গৌরবে সজ্জিত হওয়ার দাবি রাখেন। তাঁর ছবিতে ঘুরে-ফিরে আসে ধানের খেত, গরুর গাড়ি, নদী, গাছপালা, শ্রমজীবী মানুষ। এগুলো শুধু নান্দনিকতা নয়, একটি দার্শনিক অবস্থান। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে সুলতানের চিত্রকর্ম শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির নির্মম বাস্তবতাকেও উন্মোচিত করে।
একবার সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এক অনুষ্ঠানে আমাকে বলেছিলেন, এস এম সুলতানের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, জীবনযাপন, জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ নিয়ে আচার-আচরণ সবকিছুর ভিত্তিতে রয়েছে কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক এ দেশের অর্থনীতি, কৃষিভিত্তিক এ দেশের সংস্কৃতি এবং কৃষি এ দেশের স্বপ্নের নিয়ামক। এই স্বপ্ন দেখেছিলেন, এস এম সুলতান। তিনি তাঁর ছবির পর ছবিতে এঁকেছেন কৃষিভিত্তিক সভ্যতার ছবি, কৃষকের স্বপ্নের ছবি, কৃষকের শ্রম-ঘাম তাঁর ছবি এবং কৃষককে তিনি দেখিয়েছেন বলিষ্ঠ দৌর্দণ্ড চেতনার মানুষ হিসেবে। সমৃদ্ধ বলবান কৃষক হিসেবে। আমরা তো দেখেছি শিল্পী সুলতানের মতো এত বলিষ্ঠভাবে কৃষক জীবনের, কৃষক মেধা, কৃষি উৎপাদনে, এমন ছবি আর কেউ আঁকেনি।’
এস এম সুলতান শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন ‘শিশুস্বর্গ’ নামে এক অনন্য শিক্ষাকেন্দ্র। আঁকাআঁকি শেখানো, নৈতিকতা ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জাগানো ছিল এর মূল লক্ষ্য। এমনকি শিশুদের জন্য বানিয়ে ফেলেন একটি বিশাল নৌকা, যা এখনো তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি শিশুদের নিয়ে নৌকায় করে ঘুরতে যেতে চেয়েছিলেন সুন্দরবনে। নৌকাটি সংরক্ষিত আছে চিত্রা নদীর পাড়ে।
১৯৫৩ সালে সুলতান নড়াইলে ‘নন্দনকানন’ নামে একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাইস্কুল ও একটি আর্ট স্কুল গড়ে তুলেছিলেন। জীবনের শেষ ভাগে এসে তৈরি করেন ‘চারুপীঠ’। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিমানেশ চন্দ্র বিশ্বাস ও বলদেব অধিকারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা স্মৃতিচারণায় বলেছেন, কীভাবে সুলতান তাঁদের শিখিয়েছেন মাটি ও মানুষের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার শিল্প। এস এম সুলতান কখনোই যশ, খ্যাতি বা অর্থবিত্তকে প্রাধান্য দেননি। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েও তিনি নড়াইলেই থেকে গেছেন, দূরে থেকেছেন শহরের গ্ল্যামার ও শিল্প বাজারের মোহ থেকে। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী, ছিলেন মাটির কাছাকাছি। তাঁর জীবনদর্শন বলেছে- শিল্প হলো মানুষের প্রকৃত চেতনা বিকাশের মাধ্যম। তাঁর চিত্রশিল্পে যেমন ছিল দারিদ্র্যের বাস্তবতা, তেমনি ছিল ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, বাউল, জারি, সারি, ভাটিয়ালির সুরে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ একদিন নিজের আত্মপরিচয় ফিরে পাবে। তাঁর ভাবনায় কৃষক কখনোই নিছক ভূমি চাষি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সাংস্কৃতিক রূপকার।
বিমানেশ চন্দ্র বলছিলেন, এস এম সুলতান যে বলবান কৃষকের স্বপ্ন দেখেছেন সেই স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই আপনার কাজে। আমিও স্বীকার করে নিই, মহান এই শিল্পীর চিন্তা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমিও তাঁর মতো করে স্বপ্ন দেখেছি এমন এক বাংলাদেশের, যেখানে কৃষকই হবে সবচেয়ে শক্তিশালী। কৃষকই গতিশীল রাখবে সমাজ আর অর্থনীতি।
বলদেব অধিকারী বলেন, ‘এস এম সুলতানের ছবিতে বারবার উঠে এসেছে বাংলার গ্রামীণ জীবন আর প্রকৃতির রূপ। তাঁর তুলিতে দেখা যায় সবুজ ধানের খেত, স্বচ্ছ জলভরা নদী, দাঁড়টানা মাঝি, মাছধরার দৃশ্য, গ্রামের গৃহবধূ আর বলিষ্ঠ কৃষক। তিনি কৃষকদের এঁকেছেন একধরনের অতিমানবীয় শক্তিমত্তার চেহারায়। পেশিবহুল, দৃঢ়, কর্মঠ। যদিও বাস্তবে সেই সময়ের কৃষকরা এতটা বলশালী ছিলেন না, সুলতান তাঁদের দেখেছেন এক সম্মানের জায়গা থেকে। যাঁরা আমাদের অন্ন জোগান, দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখেন, তাঁদের তিনি দৃঢ় ও শক্তিশালী রূপেই কল্পনা করেছেন। শুধু কৃষকই নয়, গাঁয়ের নারীরাও তাঁর ছবিতে শক্তিময় ও বলিষ্ঠ রূপে ধরা দিয়েছেন।’
সুলতান মূলত জলরং ও তেলরঙে ছবি আঁকতেন। তবে তাঁর ব্যবহৃত কাগজ ও রঙের মান ছিল বেশ সাধারণ। কিছু ছবি তিনি কয়লা দিয়েও এঁকেছেন। এ কারণে অনেক ছবি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে।
শিল্পীর রোপণ করা নাগলিঙ্গম, আমসহ বিভিন্ন গাছ এখনো ছায়া দিচ্ছে তাঁর বসতভিটায়। তন্দ্রা আমাদের দেখালেন শিল্পীর থাকার ঘর, ব্যবহার্য বিষয়াদি, বসার চেয়ার, পরনের কাপড়। সবই সংরক্ষণ করা হয়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেখাতে। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর তিনি পরপারে পাড়ি জমান। তাঁর সমাধি সংগ্রহশালার পাশেই, প্রিয় নদীর তীরে, প্রিয় গাছের ছায়ায়। কিন্তু তাঁর ভাবনা, তাঁর ক্যানভাস, তাঁর দর্শন এখনো প্রতিটি শিল্পপ্রেমী হৃদয়ে গেঁথে আছে। আজ, ২০২৫ সালে এসে তাঁর জন্মের ১০১ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া প্রশ্ন আজও প্রাসঙ্গিক- ‘যাঁরা আমাদের অন্ন জোগায়, তাঁরা কৃশ কেন?’ হয়তো আগামী প্রজন্ম এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে সুলতানের ছবিতে, খুঁজে পাবে এই শিল্পীর প্রেমে গড়া মানুষের শিল্পদর্শনে। এস এম সুলতান আমাদের শিখিয়েছেন শিল্প হতে পারে প্রতিরোধের ভাষা, হতে পারে মাটির সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগের অনন্য মাধ্যম। তাঁর জীবন একটাই বার্তা দেয়- জীবনকে ভালোবেসে, মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে শিল্পকে সাধন করাই হলো সত্যিকারের শিল্পচর্চা। আমাদের কর্তব্য হবে শিল্পী দেশের কৃষি ও কৃষককে যেমন মর্যাদায় ভেবেছেন, সে মর্যাদায় অধিষ্ঠ করার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাওয়া।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব