মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘এমনিভাবে আমি তোমাদের এক মধ্যপন্থি জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি’ (সুরা বাকারা-১৪৩)। মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, ‘আমাকে সরল পন্থা অবলম্বনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে, চরম পন্থা অবলম্বনের জন্য নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সহজসরল পন্থা অবলম্বন কর, কঠোরতা প্রদর্শন কর না।’ ইসলাম ধর্ম অবশ্যই সহজসরল। সীমালঙ্ঘনকারী ছাড়া কেউ তা কঠিন করবে না। মহানবী (সা.)কে যে কোনো দুটি বিষয়ে অধিকার প্রদান করা হলে তিনি সহজটিই গ্রহণ করতেন। তিনি বলেন, ‘সুসংবাদ দাও, ঘৃণা ছড়িও না’ (সহিহ বুখারির কয়েকটি বর্ণনা) মহান আল্লাহ নির্দেশ করেন, ‘তোমরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না’ (সুরা নিসা-১৭১)। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে সাবধান। পূর্ববর্তীরা এতে বাড়াবাড়ির ফলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছেন (ইবনে মাযাহ)। শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলাম। চরমপন্থা, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস, দুর্নীতির স্থান এই ধর্মে নেই। নাশকতামূলক কার্যক্রম ইসলাম আদৌ সমর্থন করে না। অস্থিতিশীল পরিবেশ ও ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করা ইসলামে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অশান্ত বিশ্বে শান্তির শ্বেত কপোত ওড়াতেই ইসলামের আগমন। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনব্যবস্থা এবং ধর্মীয় বিধিবিধান বাস্তবায়নে ইসলাম মধ্যপন্থি আচরণের প্রতি উৎসাহিত করে। সব জাতি-গোষ্ঠীর প্রতি সম্প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে ইসলাম সমর্থন করে। শান্তি ও সম্প্রীতির প্রতীক এই ধর্ম। ইসলামের মূলধারার কোনো আন্দোলন অসি শক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়নি। ক্ষমা, উদারতা ও নৈতিক আদর্শের মাধ্যমে এই ধর্ম বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন আয়াতে বলেছেন, ‘তোমরা সীমা লঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না (সুরা বাকারা-১৯০)।
জীবনযাত্রা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ইসলামি শরিয়তের নির্দেশনা। মধ্যপন্থা অবলম্বনে বিপদের ঝুঁকি কম। মধ্যম অবস্থানে থাকলে উঁচু মাত্রায় উঠতে যেমন সুবিধা হয়, নিচু মাত্রায় নামার ক্ষেত্রেও অসুবিধা হয় না। ইসলাম প্রচার-প্রসারে মধ্যপন্থা এবং মহানবী (সা.)-এর অনুপম আদর্শ অবলম্বন করা সময়ের দাবি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কঠোর অবস্থান এবং চরম পন্থা গ্রহণ করা আত্মঘাতী পদক্ষেপের অন্তর্ভুক্ত। অতএব আমাদের সবাইকে মানবতার মুক্তির দিশারি মহানবী (সা.) এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার সুদৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ জানাতে হবে। ধর্মপ্রাণ জনগণকে চরম পন্থা প্রতিরোধে সজাগ সচেতন থাকার আহ্বান করতে হবে। আহ্বান করতে হবে শান্তিশৃঙ্খলা ও মধ্যপন্থা অবলম্বনের সপক্ষে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মধ্যপন্থা ও সহনশীলতা প্রচার-প্রসারে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে এক মহাপুরস্কার লাভ করেছেন কাবার প্রধান ইমাম এবং পবিত্র দুই মসজিদের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান শায়েখ ড. আবদুর রহমান আস সুদাইস। সমাজে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ প্রতিষ্ঠা এবং উগ্রবাদ প্রতিরোধে তার রয়েছে অসামান্য অবদান।
বিবাদ-বিচ্ছেদ ও যুদ্ধবিগ্রহ মূলত একটি শয়তানি চক্র। ইসলাম ঝগড়াবিবাদ ও কলুষতা সমর্থন করে না। সাম্য, মানবতা ও উদারতার প্রতীক এই ধর্ম। সুশৃঙ্খল ও সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ আচরণের শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। ঝগড়াবিবাদ ও বিচ্ছেদপূর্ণ নীতি অসামাজিক কাজ। এর ফলে পারিবারিক ও সামাজিক সংহতি এবং ঐক্য সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। আত্মীয়তার বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়। ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক জীবনে নেমে আসে অশান্তির কালো ছায়া। বাড়াবাড়ির কবলে বিস্তার হয় হানাহানি, খুন, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি। ছড়াছড়ি হয় অনৈতিক আচরণ ও অশ্লীল কথাবার্তার মতো জঘন্যতম নানামুখী অপরাধ। অশ্লীল ভাষা ব্যবহারকারীকে রসুলুল্লাহ (সা.) মুনাফিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ন্যায়সংগত কারণেও ঝগড়াবিবাদ, যুদ্ধবিগ্রহ বর্জন করার প্রতি মহানবী (সা.) উৎসাহিত করেছেন। সাহাবি আবু উমামা আল বাহেলি (রা.) বর্ণিত হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি ওই ব্যক্তির জন্য বেহেশতের প্রাণকেন্দ্রে ঘরের জিম্মাদার, যে ন্যায্য অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিবাদ থেকে বিরত থাকে। আমি ওই ব্যক্তির জন্য বেহেশতের মধ্যস্থানে ঘরের জিম্মাদার, যে কৌতুক করেও মিথ্যা বর্জন করে। আমি ওই ব্যক্তির জন্য বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থানে ঘরের জিম্মাদার, যার আচরণ হবে উত্তম’ (আবু দাউদ-সহিহ)। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও বিশ্বব্যাপী যুদ্ধংদেহি মনোভাব বিস্তার করছে। যারা শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করবে তারা আজ ব্যস্ত যুদ্ধের সাজে। সবার মধ্যে জয়পরাজয়ের প্রতিযোগিতা ও হিংসাবিদ্বেষ হানাহানিতে লিপ্ত। যাদের দায়িত্ব ছিল বিপদে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করা, তারাই আজ মনুষ্যনিধনের ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের উদার নীতি অবলম্বন করতে হবে। শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। পরিহার করতে হবে সব ধরনের ন্যক্কারজনক বাড়াবাড়ি ও মানুষ হত্যার অমানবিক ষড়যন্ত্র।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা