ক্বালব বা হৃদয়ে জিকির জারি করা অত্যাবশ্যক।
ক্বালবের ওপর পবিত্র কোরআনে ১৩২টি আয়াত নাজিল হয়েছে। ক্বালব বা হৃদয়ে আল্লাহর জিকির জারি করার মধ্য দিয়ে দিল জিন্দা হয়। ‘দিল’ ফারসি শব্দ, এর বাংলা অর্থ হৃদয়। পবিত্র কোরআনে দিল বা হৃদয়কে ‘ক্বালব’ বলা হয়েছে। আরবি ক্বালব শব্দটির বাংলা অর্থ অন্তর, হৃদয়, হৃৎপিণ্ড ইত্যাদি। আর ‘জিন্দা’ ফারসি শব্দ, এর বাংলা অর্থ জীবিত। ক্বালবে আল্লাহর জিকির জারি প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যাদের ক্বালব (বা হৃদয়) কঠোর, আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল বা বিমুখ। তারা রয়েছে প্রকাশ্য গোমরাহিতে।’ (সুরা যুমার ৩৯ : আয়াত ২২)। আল কোরআনের অন্য আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যারা ইমান আনে এবং আল্লাহর জিকিরে যাদের ক্বালব প্রশান্তি লাভ করে; জেনে রেখ আল্লাহর জিকিরেই কেবল ক্বালব প্রশান্তি লাভ করে।’ (সুরা রাদ : আয়াত ২৮)। মহান আল্লাহর জিকির ক্বালবে জারি করে মানুষ সুস্পষ্ট গোমরাহি থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে এবং ক্বালবে নুরের ইমান প্রজ্বলিত করে ইসলামের প্রকৃত শান্তি হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ফরমান, ‘আমি তোমাদের (ক্বালবের ৭ম স্তর) নাফসির মোকামে বিরাজ করি, তোমরা কি দেখো না?’ (সুরা যারিয়াত ৫১ : আয়াত ২১)। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ করেন, ‘যে (শয়তান) কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে।’ (সুরা নাস ১১৪ : আয়াত ৫)। সুতরাং স্পষ্ট যে ক্বালবের প্রথম স্তরে শয়তান অবস্থান করে, আর ক্বালবের সপ্তম স্তর নাফসির মোকামে মহান আল্লাহ বিরাজ করেন। ক্বালবে আল্লাহর জিকির জারি হলে শয়তান ক্বালব থেকে পালিয়ে যায়, ফলে শয়তান আর কুমন্ত্রণা দিতে পারে না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর রসুল (সা.) ফরমান, ‘শয়তান আদম সন্তানের ক্বালব বা দিলের মাঝে অবস্থান করে, যখন সে (স্বীয় ক্বালবে) আল্লাহর জিকির করে, শয়তান তখন সরে যায়, আর যখন সে গাফেল হয়, (শয়তান তখন) তার দিলে ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) দিতে থাকে।’ (বোখারি শরিফের সূত্রে মেশকাত শরিফ, পৃষ্ঠা ১৯৯)।
ক্বালবে জিকির জারির মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে বিদ্যমান ষড়রিপু ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখনই ক্বালবের মাঝে পরমাত্মার রাজত্ব কায়েম হয়। ক্বালবের মাঝে ষড়রিপুর প্রভাব বেশি থাকলে মানুষ মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলে এবং এর প্রভাবে তার মাঝে পশুর চরিত্র প্রকাশ পায়। এ চরিত্রের অধিকারী মানুষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হয় হুমকিস্বরূপ। অন্যদিকে মানুষ যদি সাধনার মাধ্যমে নিজের পরমাত্মাকে শক্তিশালী করতে পারে, তখন সেই মানুষটি হয় আলোকিত মানুষ। উত্তম চরিত্রাদর্শ অর্জনের ফলে তার মাঝে শান্তির চরিত্র প্রকাশ পায়। এভাবে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিটি আশরাফিয়াতের গুণ অর্জন করে আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। মানুষের মুক্তি, শান্তি ও কল্যাণের পূর্বশর্ত ক্বালবে আল্লাহর জিকির জারি বা দিল জিন্দা করা। দিল জিন্দার মাধ্যমেই মানুষ জীব চরিত্রের ঊর্ধ্বে ওঠে আল্লাহর প্রতিনিধির চরিত্র অর্জন করতে পারে। ক্বালবের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত নুমান ইবনে বশির (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখ, নিশ্চয়ই মানব দেহের মধ্যে একটি মাংসের টুকরো আছে, সেটি যখন ঠিক (পবিত্র) হয়ে যায়, তখন গোটা শরীরটাই ঠিক (পবিত্র) হয়ে যায়, আর সেটি যখন খারাপ (অপবিত্র) হয়ে যায়, গোটা শরীরই খারাপ (অপবিত্র) হয়ে যায়। জেনে রেখ, সেই মাংসের টুকরোটি হলো ক্বালব (বা হৃদয়)।’ (বোখারি শরিফ প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ১৩)।
হজরত রসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষের ক্বালব ভালো অর্থাৎ পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন তার গোটা শরীর পরিশুদ্ধ হয়ে যায় আর যখন মানুষের ক্বালব খারাপ তথা দুষ্কর্মময় হয়ে পড়ে তখন পুরো শরীরটাই খারাপ হয়ে যায়।’ (তাফসিরে মিজান, ১৫নং খ , পৃষ্ঠা ১০৮)। বিশুদ্ধ ক্বালবের গুরুত্ব প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি কোনো কাজে আসবে না, সেদিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহর কাছে আসবে ক্বালবে সালিম তথা বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে।’ (সুরা আশ শুআরা ২৬ : আয়াত ৮৮ ও ৮৯)। ক্বালবে সালিম বা বিশুদ্ধ অন্তর তখনই হবে, যখন ক্বালবের মাঝে আল্লাহর জিকির জারি হবে, অর্থাৎ দিল জিন্দা থাকবে। দিলে জিকির জারি থাকলে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় এবং বিপদে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদের স্মরণ করব।’ (সুরা বাকারা ২ : আয়াত ১৫২)।
লেখক : সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, পিইউবি