চট্টগ্রামের শুঁটকিশিল্প একসময় দেশের উপকূলীয় অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে পরিচিত ছিল। ফাইশ্যা, লইট্টা, ছুরি, মধুভাইস্যা, পোয়া, রূপচাঁদা এসব মাছ থেকে তৈরি শুঁটকি শুধু দেশের বাজারেই নয়, বিদেশেও সুখ্যাতি ও আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। সেই ঐতিহ্যবাহী শিল্প আজ গভীর সংকটে। বলা যায় অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
মৎস্যভিত্তিক এই শিল্পসংকটের মূলে রয়েছে একাধিক জটিল কারণ। প্রথমত মাছের দুষ্প্রাপ্যতা এবং কাঁচা মাছের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। উপকূলীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত মাছ ধরা, সমুদ্রদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও গভীর সমুদ্রে ট্রলারের আধিপত্য- সব মিলিয়ে ছোট জেলেরা পর্যাপ্ত মাছ পাচ্ছেন না। এর ফলে কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে শুঁটকি উৎপাদনে, যা প্রভাব ফেলছে উৎপাদন পরিসংখ্যানে।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য ভয়াবহ এক বাস্তবতা সামনে আনে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুঁটকির উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৪২০ টন, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮৭০ টনে। সর্বশেষ মৌসুমে উৎপাদন আরও নেমে গেছে ৫০০ টনের নিচে। এটি শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং হাজারো ক্ষুদ্র উৎপাদক ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনজীবিকার সামনে অশনিসংকেত। দ্বিতীয়ত এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ক্ষুদ্র উৎপাদকরা আর্থিক দুরবস্থায় পড়েছেন। পুঁজি না থাকায় তারা উৎপাদন ব্যয় সামলাতে পারছেন না। সরকার বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের
কাছ থেকে পর্যাপ্ত ঋণসহায়তা না থাকায় অনেকেই পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। একসময় চট্টগ্রাম শহরের নোমান কলেজ এলাকা, ইছানগর, জুলধা ও কর্ণফুলী তীরজুড়ে শতাধিক শুঁটকিপল্লি ছিল; এখন তার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে হাতেগোনা কয়েক ডজনে। উৎপাদন কমে গেলেও চাহিদা কিন্তু কমেনি। বরং বেড়েছে বহু গুণে। ফলে বাজারে দামের অস্বাভাবিক উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। চিংড়ি শুঁটকি তিন বছর আগেও যেখানে কেজিপ্রতি ৭০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায় পৌঁছেছে। একইভাবে ছুরি ও লইট্টা শুঁটকির দাম বেড়েছে তিন গুণের বেশি। ফলে সাধারণ ক্রেতা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি এই অতিমূল্যের বাজার উৎপাদকদের জন্যও স্থিতিশীল নয়।
তৃতীয়ত মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সস্তায় শুঁটকি আমদানি। ওই শুঁটকি বাজার দখল করায় দেশীয় উৎপাদকরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। এই অনিয়ন্ত্রিত আমদানি স্থানীয় শিল্পের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করেছে। সস্তায় বিদেশি পণ্যের আগমনে দেশীয় শুঁটকিশিল্প কার্যত ধ্বংসের পথে।
অথচ এই শিল্পের সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে যুক্ত কয়েক হাজার পরিবার। তাদের জীবিকা, স্থানীয় অর্থনীতি, এমনকি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও জড়িয়ে আছে এই শিল্পের সঙ্গে। একসময় চট্টগ্রামের শুঁটকি শুধু খাদ্যপণ্য ছিল না; এটি ছিল একধরনের ‘গর্বের ব্র্যান্ড’, যা কক্সবাজার থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বাণিজ্যের সেতুবন্ধ রচনা করেছিল। সেই গৌরব এখন স্মৃতির পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন একটি সমন্বিত পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা। ১. ক্ষুদ্র উৎপাদকদের জন্য সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। ২. উপকূলীয় জেলেদের সুরক্ষা ও মাছের প্রজনন মৌসুমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা প্রয়োগ করা জরুরি। ৩. বিদেশি শুঁটকি আমদানি নিয়ন্ত্রণে নীতিগত পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন দেশীয় শিল্প ন্যায্য প্রতিযোগিতার সুযোগ পায়। একই সঙ্গে আধুনিক সংরক্ষণ প্রযুক্তি, গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানিযোগ্য ব্র্যান্ড তৈরি করতে হবে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে। শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, প্রয়োজন বাজার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। চট্টগ্রামের শুঁটকিশিল্পের পুনরুত্থান সম্ভব, যদি এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়। না হলে একসময় যে শিল্পটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য বহন করত, তা হারিয়ে যাবে সময়ের গর্ভে একটি ঐতিহ্য, একটি জীবিকা এবং একখণ্ড ইতিহাসের সঙ্গে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী