রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘রাশিয়া কখনো যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মাথা নত করবে না।’ তবে তিনি স্বীকার করেছেন, ওয়াশিংটনের আরোপ করা নতুন নিষেধাজ্ঞায় তাঁর দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা ক্ষতি হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দুটি তেল কোম্পানিকে লক্ষ করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর চীন ও ভারত রুশ তেল আমদানি কমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে এরই মধ্যে খবর পাওয়া গেছে। বুধবার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এদের প্রায় তিন ডজন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও। ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ করতে ক্রেমলিনের ওপর চাপ বাড়ানোর অংশ হিসেবে ট্রাম্পের প্রশাসন এ পদক্ষেপ নিয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়ার তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ধীরে ধীরে আলাদা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
রসনেফট ও লুকঅয়েল রাশিয়ার মোট অপরিশোধিত তেল রপ্তানির প্রায় অর্ধেকের জোগান দেয়। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যও এ দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফেরার পর এটিই (বুধবার ওয়াশিংটনের আরোপ করা) মস্কোর ওপর প্রথম বড় নিষেধাজ্ঞা। এর লক্ষ্য রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের তহবিলের প্রধান উৎস তেল আয়ের প্রবাহ বন্ধ করা।
ওয়াশিংটন আশা করছে, এ নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈশ্বিক তেলের দাম ৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার পর পুতিনের ওপর এমন চাপ তৈরি হবে, যাতে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে আলোচনায় ফিরতে বাধ্য হবেন।
বৃহস্পতিবার পুতিন নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলোকে ‘রুশ-মার্কিন সম্পর্ক শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কোনোই কাজে না আসা অমৈত্রীসুলভ পদক্ষেপ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটি রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার এক ব্যর্থ চেষ্টা।’ ‘কোনো আত্মমর্যাদাশীল দেশ কখনো চাপের মুখে নতি স্বীকার করে না’, রুশ সাংবাদিকদের বলেন পুতিন। প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, ‘নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো রাশিয়ার ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না। তবে কিছু ক্ষতি হবে।’
পুতিন ট্রাম্পকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তাঁর উপদেষ্টারা যখন রুশ তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞার পরামর্শ দেন, তখন প্রেসিডেন্টের ভাবা উচিত, তাঁর প্রশাসন আসলে কার স্বার্থে কাজ করছে।’ তিনি সতর্ক করে দেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে তেলের দাম আরও বাড়বে।
এ ছাড়া রুশ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সতর্ক করে বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দেয় এবং সেগুলো দিয়ে রাশিয়ার ওপর হামলা চালানো হয়, তবে রাশিয়া ব্যাপক ধ্বংসাত্মক না হলেও খুবই শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখাবে।’ উল্লেখ্য, ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এ ক্ষেপণাস্ত্র চাইছে। কিন্তু ওয়াশিংটন এখনো রাজি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিকতম নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো বিদেশি রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার বড় তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে না। এতে রাশিয়া অনেকাংশেই আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে চলে যাবে। গতকালই ইঙ্গিত পাওয়া যায়, রাশিয়ার তেলের দুই প্রধান ক্রেতা চীন ও ভারত ওয়াশিংটনের ওই নতুন নিষেধাজ্ঞার জবাবে দেশটি থেকে জ্বালানি আমদানি স্থগিত করছে।
রুশ তেলের সবচেয়ে বড় ভারতীয় ক্রেতা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তারা রুশ তেল আমদানি কমানো বা সাময়িক বন্ধ রাখার কথা ভাবছে। প্রতিষ্ঠানের একজন মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘রুশ তেল আমদানির বিষয়ে পুনর্মূল্যায়ন চলছে এবং রিলায়েন্স সম্পূর্ণভাবে ভারত সরকারের নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করবে।’
রয়টার্সকে আরও কয়েক সূত্র বলেছেন, চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলোও আপাতত সমুদ্রপথে রুশ তেল কেনা স্থগিত করেছে। তারা আশঙ্কা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে বড় ঝুঁকিতে পড়তে হবে।
রাশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৫ ভাগের ১ ভাগই আসে তেল ও গ্যাস খাত থেকে। তাই ভারত ও চীনের মতো প্রধান দুই ক্রেতা হঠাৎ চাহিদা কমালে ক্রেমলিনের তেল রাজস্বে বড় আঘাত আসবে এবং বৈশ্বিক তেলের দাম আরও বেড়ে যাবে।
চীন রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র। আর ভারত ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছে। দুই দেশই এ পর্যন্ত পশ্চিমাদের রুশ জ্বালানি কেনা বন্ধের আহ্বানকে গুরুত্ব দেয়নি। তারা একে ফাঁকা হুমকি হিসেবেই দেখে এসেছে।
নিষেধাজ্ঞা মানলে ভারত ও চীনকে সস্তায় রুশ তেল কেনা বন্ধ করতে হবে। সাশ্রয়ী মূল্যে রুশ তেল কেনার এ সুযোগ এখন পর্যন্ত ভারত-চীনের অর্থনীতি জ্বালানি খাতের উচ্চ মূল্যজনিত বৈশ্বিক ধাক্কা থেকে রক্ষা করেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ক্রমবর্ধমান হতাশার মধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসন হঠাৎ এসব নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের নির্ধারিত এক শীর্ষ বৈঠক আকস্মিক বাতিল করার ঘটনা।
ওই সম্মেলন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নে পুতিন বলেন, ‘এটি সম্ভবত বাতিল করা হবে। কারণ যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া এমন বৈঠক করা ভুল সিদ্ধান্ত হবে।’ রুশ প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, তিনি এখনো ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী। কেননা সংলাপ সব সময় যুদ্ধের চেয়ে ভালো।
তবে রুশ প্রশাসনের অন্য নেতারা অনেক কঠোর ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট, নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ সদস্য দিমিত্রি মেদভেদেভ নিষেধাজ্ঞাগুলোকে ‘যুদ্ধের ঘোষণা’ বলে মন্তব্য করেছেন।
‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শত্রু’, সমাজমাধ্যমে লিখেছেন মেদভেদেভ। ‘তাদের কথাবার্তা যতই শান্তির বার্তা দিক না কেন, তারা এখন পুরোপুরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পথে নেমেছে।’
ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ কিছু বিশেষজ্ঞও স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ রুশ অর্থনীতিকে আঘাত করতে পারে। -দ্য গার্ডিয়ান