গাজার যুদ্ধবিরতি চুক্তি রক্ষায় সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের ওপর আমেরিকার নজিরবিহীন চাপ নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলছেন, ইসরায়েল কি তবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’ বা নির্ভরশীল রাজ্য হিসেবে কাজ করছে? কেউ আবার বলছেন, ইসরায়েল কি আমেরিকার ৫১তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে? এ নিয়েই একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আলজাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন কর্মকর্তাদের ইসরায়েল সফর ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রথমে বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার, এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং সবশেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তাদের সবার একমাত্র লক্ষ্য ছিল গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি টিকিয়ে রাখা। এর অর্থ হলো, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অতি-ডানপন্থি সরকারকে যে কোনো অজুহাতে যুদ্ধ পুনরায় শুরু করা থেকে বিরত রাখা।
মার্কিন কর্মকর্তাদের এ সফরকে অনেক বিশ্লেষকই ইসরায়েলি সরকারকে শিশুদের মতো দেখেশুনে রাখার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাদের বক্তব্য, ওয়াশিংটন যখন ইসরায়েলকে কিছু করতে নির্দেশ দেয়, তখন তেল আবিবকে শেষ পর্যন্ত তা মানতেই হয়। বিশ্লেষকদের এ বক্তব্যের মূল কারণ আমেরিকার বিপুল আর্থিক ও সামরিক সহায়তা। সেই সঙ্গে জাতিসংঘে অসংখ্যবার ভেটো দিয়ে ইসরায়েলকে রক্ষা করার নীতি। আর ট্রাম্প প্রশাসন এবার সেই সমর্থনকেই কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলকে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতে বাধ্য করছে।
টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই দাবি করেছেন, তিনি নেতানিয়াহুকে গাজার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছেন। ইসরায়েলের পার্লামেন্ট বা নেসেটে পশ্চিম তীর দখলের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার পরপরই ট্রাম্প স্পষ্ট করে দেন, এমনটা হলে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সব সমর্থন হারাবে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সও এ ভোটাভুটিকে খুবই বোকামি বলে আখ্যা দেন। চাপের মুখে নেতানিয়াহুর দপ্তরও এ ভোটকে রাজনৈতিক উসকানি বলে অভিহিত করে।
চ্যাথাম হাউসের সিনিয়র কনসাল্টিং ফেলো ইয়োসি মেকেলবার্গ আলজাজিরাকে বলেছেন, নেতানিয়াহুকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে যা বলা হবে, তাই করতে হবে। যদিও সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে ভিতরে ভিতরে কাজ করার কৌশল নিয়েছিল, যা কাজে আসেনি। কিন্তু ইসরায়েলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ট্রাম্প তুলনামূলক বেশি সংঘাতমূলক পথ বেছে নিয়েছেন, যা এখন কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহু যখন সেপ্টেম্বরে হামাসের আলোচক দলের ওপর হামলা চালান, তখন উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার এবং বিশেষ দূত উইটকফ একটু প্রতারিত বোধ করেছিলেন। কুশনার আরও বলেন, ট্রাম্প মনে করেছিলেন ইসরায়েলিরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাদের থামানো প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের এ কৌশলকে নেতানিয়াহুর সাবেক সহযোগী মিচেল বারাক গাজায় যুদ্ধবিরতি ব্যবস্থাপনায় গাজর-লাঠি নীতির প্রয়োগ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এদিকে নেতানিয়াহু অবশ্য ইসরায়েলের স্বাধীনতা হারানোর এ অভিযোগকে ফালতু কথা বা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, এক সপ্তাহে তারা বলে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক সপ্তাহ পরে বলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা ফালতু কথা।
তবে বিশ্লেষক অ্যালন পিংকাসের মতে, এ ঘটনাগুলো নেতানিয়াহুকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার বিকল্প সীমিত। ডেমোক্র্যাটরা তাকে পছন্দ করে না, জনমত তার বিরুদ্ধে। রিপাবলিকানদের মধ্যেও তাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তাই তিনি আর আগের মতো এক পক্ষের বিরুদ্ধে অন্য পক্ষকে ব্যবহার করতে পারছেন না।
গাজা যুদ্ধবিরতি কার্যকর রাখা থেকে শুরু করে পশ্চিম তীর দখলের মতো সংবেদনশীল ইস্যুতে নেতানিয়াহুর সরকারকে প্রকাশ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশ মানতে বাধ্য হওয়ার এ ঘটনা আমেরিকা-ইসরায়েল সম্পর্কের ক্ষমতার ভারসাম্য স্পষ্ট করে দিল বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।