প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা বাদ দিয়েও বলা যায় দেশব্যাপী রাজশাহীর সুনাম প্রধানত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শহর হিসেবে। শহরজুড়ে আধুনিক চওড়া সড়ক ব্যবস্থাপনা ও ফুটপাত আরামে হেঁটে চলাচলের জন্য নগরবাসীর প্রিয়। ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকে ঋতুভেদে লাগানো বিভিন্ন জাতের ফুলের সৌন্দর্য নগরবাসীকে মোহিত করে। একসময় নির্মল বায়ুর শহর হিসেবেও পৃথিবীব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছে রাজশাহী। আলোকবাতির কারণে রাতের শহর মুগ্ধ করবে যে কাউকে। পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা রাজশাহী শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ পাড় থেকে নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ। টি-বাঁধ, আই-বাঁধসহ শহরের কয়েকটি স্পট বিনোদনপ্রেমীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। একসময় যে রাজশাহীকে গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি, হেলদি সিটি ও এডুকেশন সিটি বলা হতো, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা এখন ম্লান হওয়ার পথে। অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এর অন্যতম কারণ। শহরের কোথাও কোনো শৃঙ্খলা নেই। নির্মল বায়ুর শহর এখন দূষিত বায়ুর শহরে পরিণত হয়েছে।
বছরজুড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাচীন গাছ কাটা, একের পর এক পুকুর-জলাশয় ভরাট করা হয়েছে, কোনো নিয়মনীতি না মেনেই শহরে অটোরিকশা বাড়তে দেওয়া, এমনকি বাসমালিক সমিতির দৌরাত্ম্যে শহরের ভিতর থেকে বাস টার্মিনাল সরিয়ে নেওয়া হয়নি। ফলে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জনবল বাদ দেওয়ায় শহরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কার্যক্রম সেভাবে হয় না বললেই চলে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সড়ক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। যেসব ময়লা জমা হয় নগরীর ১৮টি পয়েন্টে রাখা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে। সেখান থেকে রাতে নিয়ে গিয়ে নগরীর উপকণ্ঠে সিটি হাট এলাকায় ডাম্পিং করা হয়। গণ অভ্যুত্থানের পর নানা কারণে প্রায় শতাধিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী চাকরিচ্যুত হন। ১ হাজার ৩১৩ জনের বিশাল কর্মী বাহিনী থাকলেও সিটি করপোরেশনে এখন ঠিক সেভাবে রাস্তাঘাট ও ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে না। এজন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যায়। আবার প্রতিদিন উৎপাদিত ৩৫০ থেকে ৪০০ মেট্রিক টন বর্জ্য কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই সিটি হাট এলাকায় ডাম্পিং করা হচ্ছে, যা বৃষ্টির পানিতে কৃষি জমি ও নদীনালায় গিয়ে মিশছে। এ ছাড়া ১০ হাজার অটোরিকশা ও ৫ হাজার রিকশার লাইসেন্স থাকলেও শহরে চলছে ২৫ হাজারের বেশি যানবাহন, যা ব্যাপক যানজট সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন রাস্তায় খানাখন্দের সৃষ্টি হলেও তা সংস্কার করা হচ্ছে না। জনপ্রতিনিধি না থাকায় কোনো শৃঙ্খলা নেই। ফলে কোনো কাজই ঠিকমতো হচ্ছে না। শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে না। যানবাহনে শৃঙ্খলা নেই, ফুটপাতগুলো দখল হয়ে একটি ঘিঞ্জি শহরে পরিণত হচ্ছে। এ ছাড়া আগে ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকে লাগানো গাছে নিয়মিত পানি দেওয়া হতো, এখন সেই কাজও করা হচ্ছে না। ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মশার উপদ্রব বেড়েছে। আবার নির্মাণকাজ করার পর যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হচ্ছে। অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ করায় বায়ুদূষণ বাড়ছে। অর্থাৎ রাজশাহীকে যে গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি ও হেলদি সিটি বলা হতো, তার প্রায় সব মহিমাই হ্রাস পাচ্ছে। দ্রুত এসব বিষয়ে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজশাহীতে কর্মসূত্রে প্রত্যক্ষ করেনি- এ শহরে বস্তিবাসীর জন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই। শহরকে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। রাজশাহীতে প্রান্তিক মানুষদের জন্য বাসস্থান গড়ে তোলা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আমাদের নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে- আমরা রাজশাহীকে কোন অবস্থায় দেখতে চাই।
রাজশাহীতে শ্রমঘন শিল্পের কারখানা হবে, না সেবামূলক শিল্পের কারখানা হবে? সেবামূলক শিল্পকারখানার মধ্যে আছে প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন। এক একটা শহরের আসলে এক একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সেই বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে শহরের উন্নয়ন করতে হয়। রাজশাহীতে নিশ্চয় শ্রমঘন শিল্পের কারখানা স্থাপন করার চেয়ে বেশি বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে রাজশাহীকে ভাবতে হবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী