চট্টগ্রাম মহানগরের বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট সড়কের উত্তরাংশ একসময় নির্জন পাহাড়ি এলাকা ছিল। পুবে হাটহাজারী ও পশ্চিমে মহাসড়কঘেরা সলিমপুর ইউনিয়নের এ পাহাড়ি অঞ্চলে কয়েক দশক আগেও বন্যপ্রাণীর আনাগোনা লক্ষ করা গেছে। তিন দশকের ব্যবধানে এ এলাকায় নির্বিচার পাহাড় ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ বসতি। পাহাড় কেটে গড়ে তোলা এ আবাসিক এলাকা এখন অপরাধের অভয়ারণ্য। একাধিবার অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয় অসহায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। দেশের ভিতরে ভিন্ন কোনো দেশ!
নব্বইয়ের দশকে ছিন্নমূলদের আশ্রয় দেওয়ার নামে স্থানীয় প্রভাবশালী আলী আক্কাসের মাধ্যমে দখল শুরু হয়। ৩ হাজার একরের বেশি ভূমির প্রায় পুরোটাই সরকারি মালিকানার পাহাড় কেটে। ২০১০ সালে আক্কাসের মৃত্যুর পর থেকে স্থানীয় মশিউর, ইয়াছিন, ফারুক, রোকনসহ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তাদের প্রত্যক্ষ মদতে সেখানে ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ’ এবং ‘আলীনগর সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে দুটি সংগঠন ২০ হাজারের বেশি প্লট তৈরি করে বিক্রি করেছে। এ দুই সমিতিতে ৩০ হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে। বিক্রি করা এসব প্লটের এক একটির মূল্য ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত।
এলাকাটি মূলত ওই দুটি সংগঠনই পরিচালনা করে। দেশের প্রচলিত আইনকানুনের তোয়াক্কা নেই এখানে। সংগঠন দুটির নেতারাই এখানকার নিয়মকানুন ঠিক করেন। এ যেন দেশের ভিতরে ভিন্ন কোনো দেশ। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের পরিচয়পত্র রয়েছে। ফলে এলাকাটিতে প্রবেশের একমাত্র পথে সেটি দেখিয়ে তারা যাতায়াত করেন। তবে বাইরের কেউ যেতে হলে ওই এলাকার কারও মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত হওয়া ছাড়া ভিতরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও যদি অবৈধ বসতি উচ্ছেদে ভিতরে যেতে চায়, তারা প্রবেশপথে আসার পরই খবর পৌঁছে যায় সমিতির নেতাদের কাছে। এরপর তারা একজোট হয়ে প্রশাসনকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পাশাপাশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখানে কয়েকটি পক্ষের মধ্যে হামলা-সংঘর্ষ নিত্যদিনের ব্যাপার।
নিশ্চিহ্ন অর্ধশতাধিক পাহাড়, অসহায় সরকারি দপ্তর : জঙ্গল সলিমপুর এলাকাটি মিরসরাই রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। এ রেঞ্জের পাহাড়গুলো মূলত শক্ত মাটি দিয়ে তৈরি। তিন দশক আগে এর পুরোটাই জুড়ে ছিল বৃহদাকৃতির পাহাড়ে ঘেরা। পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর হিসাবে গত তিন দশকে এখানে অর্ধশতাধিক পাহাড় কেটে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। আর যখনই পরিবেশ অধিদপ্তর বা অন্য কোনো দপ্তর পাহাড় কাটা ও অবৈধ বসতি গড়ে তোলার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গেছে তখনই হামলার শিকার হয়েছে। গত এক দশকে এখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, পুলিশ, ইউএনও, এসিল্যান্ড, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সাংবাদিকসহ অনেক দপ্তরের কর্মকর্তা হামলার শিকার হয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের সহকারী পরিচালক মুক্তাদির হাসান জানান, ‘এখনো ঠিক কয়টি পাহাড় কাটা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বলা মুশকিল। তবে অর্ধশতাধিক ছোটবড় পাহাড় কাটা হয়েছে এটা অনুমান করা যায়। এখানে বারবার অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হতে হচ্ছে। তবে সম্প্রতি এ অবৈধ বসতি উচ্ছেদে সুপারিশ তৈরি করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অপরাধের অভয়ারণ্য : তিন দশক আগের শান্ত এ পাহাড়ি অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাস, মাদক কারবার, অবৈধ অস্ত্র কারবারসহ নানা রকম অপরাধের স্বর্গরাজ্য। এলাকাটি পাহাড়ঘেরা হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও অপরাধীদের খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। এ কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধ করে অপরাধীরা এখানে পালিয়ে থাকে। চলতি মাসের শুরুর দিকেও এ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। স্থানীয় ইয়াছিন ও রোকনের নেতৃত্বধীন দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এ ছাড়া সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া দুজন সাংবাদিককে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে তাঁদের ক্যামেরা, মোবাইল ফোন ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র লুটে নেয় সন্ত্রাসীরা। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে অভিযান করতে গিয়ে অনেকবার হামলার শিকার হতে হয়েছে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে কীভাবে অভিযান পরিচালনা করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা চলছে। আশা করছি শিগগিরই ভালো কিছু হবে।’
ঝুলে গেছে সরকারি প্রকল্প : ২০২২ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ এলাকার অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার-২, নভোথিয়েটার, মডেল মসজিদসহ বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আধুনিক ও পরিকল্পিত উপশহর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। এ ছাড়া আরও ৪৮টি সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এখানে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণের আবেদন করে জমি বরাদ্দ চায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে কিছু উচ্ছেদ কার্যক্রমও পরিচালিত হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের বদলির পর উদ্যোগটি থমকে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে জানান, আপাতত অবৈধ বসতি উচ্ছেদই মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদ করা গেলে পরবর্তীতে উপশহর বা অন্য যে কোনো কিছু নিয়ে ভাবা যেতে পারে।