দেশ স্বাধীনের ৫৪ বছরে বাংলাদেশ সরকার মাত্র ১০০টি গ্যাস কূপ খনন করতে সক্ষম হয়েছে। যা দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা অনুপাতে খুবই নগণ্য। প্রাকৃতিক গ্যাসের জোগান দিনকে দিন কমে আসায় এরই মধ্যে সরকার গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধিতে সাঁড়াশি অভিযান বা ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সাতটি রিগ দিয়ে বর্তমানে একসঙ্গে স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের তোড়জোড় চলছে। আসছে ডিসেম্বরে আরও তিনটি রিগ দিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা হবে। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র নিশ্চিত করেছে, এ পর্যন্ত ৫০টি গ্যাস কূপের মধ্যে ১৯টি কূপ খনন শেষে ২০২ মিলিয়ন ঘনফুট নতুন গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সাঁড়াশি অভিযান আগামী কয়েক বছর টানা চললে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলা মিলে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনে ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছে। এ অনুসন্ধান কার্যক্রম যদি টানা কয়েক বছর চলে তাহলে গ্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ বছরের মধ্যে কৈলাসটিলা-১ এর ওয়ার্কওভার শেষ হবে। একই সঙ্গে সিলেট-১০এক্স, হবিগঞ্জ-৫, শ্রীকাইল-৫, সেমুতাং-৬, বিয়ানিবাজার-২ এর কাজ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাপেক্সের মাধ্যমে জামালপুর-১ অনুসন্ধান কূপ খননের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো ব্লক-৮ এর বাণিজ্যিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। জামালপুর স্ট্রাকচারে গ্যাসের রিজার্ভের পরিমাণ ও বিস্তৃতি মূল্যায়নের জন্য আরও দুটি (একটি উন্নয়ন ও একটি অনুসন্ধান) কূপ খননের লক্ষ্যে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লি. (এফজিএফএল)-এর অন্তর্গত হরিপুর গ্যাস ফিল্ডে সিলেট-১০ কূপ খননের সময় সেখানে জ্বালানি তেলের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। হরিপুর স্ট্রাকচারে মজুতকৃত জ্বালানি তেল বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন নিশ্চিত করতে সিলেট-১২ তেল কূপ খননের কার্যক্রম চলছে। ভোলায় প্রাপ্ত গ্যাসের মজুত ও বিস্তৃতি নির্ণয়ের জন্য এ এলাকায় আরও ১৯টি নতুন কূপ খননের কাজ চলছে। ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্য ভোলা-বরিশাল ও ভোলা-খুলনা পাইপলাইন নির্মাণের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে। এ ছাড়া গ্যাসের মজুত মূল্যায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লি. (বিজিএফসিএল)-এর আওতায় তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ডে এবং বাপেক্সের আওতায় শ্রীকাইল গ্যাস ফিল্ড ও মোবারকপুর স্ট্রাকচারে দুটিসহ মোট চারটি গভীর কূপ খননের কার্যক্রম চলছে।
পেট্রোবাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি এবং জ্বালানি চাহিদা মেটাতে ৫০টি ও ১০০টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার কর্মপরিকল্পনাসহ দেশের বিভিন্ন ব্লকে অনুসন্ধান ও নতুন কূপ খনন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫০টি কূপের ১৯টির কাজ শেষ। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে পাইপলাইন, গ্রিড না থাকায় এ পর্যন্ত মাত্র ৮২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অবশিষ্ট গ্যাস সরবরাহে বিভিন্ন পাইপলাইন নির্মাণ হচ্ছে বা এজন্য প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। পাইপলাইন সংযোগ না থাকায় শুধু ভোলার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। আবার ২০২২ সালে কাজ শুরু হওয়া ৫০টি কূপ বিশেষ বিধানের আওতায় ছিল। বিশেষ বিধান বাতিল হওয়ায় এগুলোর জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৫০টির মধ্যে ২০টিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ১০টি চুক্তি এরই মধ্যে হয়ে গেছে আর দুটির আগামী মাসে হবে। বাকিগুলোর জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর কাজও এগিয়ে চলছে।
এই ৫০টি কূপের মধ্যে ৩৪টি উন্নয়ন ও অনুসন্ধান কূপ। আর ১৬টি ওয়ার্কওভার কূপ (গ্যাস কূপের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সংস্কার করা)। আর ১০০টির মধ্যে ৬৯টি হচ্ছে উন্নয়ন ও অনুসন্ধান কূপ আর ৩১টি ওয়ার্কওভার কূপ। ৫০টি কূপের কাজ ২০২২ সাল থেকে শুরু করে মেয়াদ ২০২৫ পর্যন্ত ধরা হয়। মাঝে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে কাজ বিঘ্নিত হয়। এখন ৫০টি কূপের ১৮টির ডিপিপি হয়েছে যার ১৬টি অনুমোদন হয়েছে। আরেকটি আগামী মাসে হবে। আর ১০০ কূপের কাজ ২০২৬-এর জুলাই মাস থেকে শুরু হবে। এর মধ্যে ছয়টি প্রকল্প টাইমলাইনে নেওয়া হয়েছে। আসছে ডিসেম্বরের মধ্যে এর অনেকের অনুমোদন হয়ে যাবে। ১০০ কূপের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২৮ পর্যন্ত।
দেশের ইতিহাসে কখনো এর আগে গ্যাস কূপ খননে এতগুলো রিগ একসঙ্গে কাজ করেনি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লি. (বাপেক্স)-খনন কাজে গতি বাড়াতে বিদ্যমান ৫টি রিগের পাশাপাশি আরও দুটি নতুন রিগ কেনার জন্য কাজ চলছে। যার মধ্যে একটি রিগ ক্রয়ের প্রস্তাব একনেকে পাস হয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরের মধ্যে টার্ন-কি পদ্ধতিতে বিজিএফসিএল-এর সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত কোম্পানি সিসিডিসির আওতায় আরও দুটি রিগের মাধ্যমে তিতাস-২৮ উন্নয়ন কূপ ও তিতাস-৩১ ডিপ অনুসন্ধান কূপের খনন কাজ শুরু হবে। আর ভোলায় কূপ খননের জন্য বাপেক্স এবং তৃতীয়পক্ষীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিনোপ্যাক, চায়নার শিগগিরই চুক্তি সই হবে। এতে ভোলায় কূপ খননে আরও একটি রিগ নিয়োজিত হবে। সব মিলে মোট ১০টি রিগ একসঙ্গে কূপ খননের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। সাধারণত ওয়ার্কওভারের কাজ হলে কোনো কোনো সময় একটি রিগ দিয়ে চারটি কূপের কাজ করা যায়। কিন্তু গড়ে তিনটি কূপ খননের কাজ ধরা হলে এই ১০টি রিগ দিয়ে বছরে ৩০টি কূপ খননের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। অথচ দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১০০টি গ্যাস কূপ খনন করা সম্ভব হয়েছে। যা খুবই নগণ্য। এ পর্যন্ত মোট কূপ খনন হয়েছে ২৫৮টি। কিন্তু দেশে গ্যাসের চাহিদা বেশি। আর দেশীয় উৎস থেকে যেভাবে গ্যাস উৎপাদন কমে যাচ্ছে তার হারও বেশি। বছরে দেশীয় কূপ থেকে গড়ে ২০০ মিলিয়ন করে গ্যাস উৎপাদন কমে যাচ্ছে। তবে পাঁচটি রিগ পরিচালনা করা বাপেক্সের জন্য বর্তমানে কঠিন, কারণ তাদের জনবল কম। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি লোক নিয়োগ করছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোক নিয়ে আসবে বলে জানা যায়।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) এবং বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, যে রিগগুলো আমরা কিনতে চাচ্ছি তা স্থলভাগের জন্য। সরকার যে ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে তা চলমান আছে। সিলেট গ্যাস ফিল্ড, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লি. (বিজিএফসিএল) আর বাপেক্স বিভিন্ন স্থানে এই কূপ খননের কার্যক্রম করছে। নতুন রিগগুলো কেনার ফলে দেশে একই সময়ে কূপ খননের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে।