ক্রমেই গভীর হচ্ছে দেশের অর্থনীতির সংকট। একের পর এক চালু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারত্বের হার দ্রুত বাড়ছে। অনেক কারখানা বন্ধ না হলেও ধুঁকে ধুঁকে চলছে। তারাও শ্রমিক ছাঁটাইয়ে বাধ্য হচ্ছে। উৎপাদন কমে যাচ্ছে। রপ্তানি, রাজস্ব আয়সহ নানা খাতে তার প্রভাব পড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা।
গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ঢালাওভাবে শিল্পমালিক ও উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে মামলা, মামলা বাণিজ্য, হামলা, মব সন্ত্রাস, কারখানা ভাঙচুর, দখল, অগ্নিসংযোগের মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে। গ্যাস-বিদ্যুতের অব্যাহত সংকটের কারণে কোনো কোনো শিল্প এলাকায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে ভয় পাচ্ছেন। এতে নতুন উদ্যোগ যেমন হচ্ছে না, বিদ্যমান উদ্যোগের সম্প্রসারণও ব্যাহত হচ্ছে। রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্রমেই তা বাড়ছে। সঠিক পদক্ষেপের অভাবে পরিস্থিতি দিনদিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিবেশ। বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সহনশীলতা সূচকে ২২৬টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১৯৩তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এখানে বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। সম্প্রতি বৈশ্বিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স এই ‘গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট রিস্ক অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স ইনডেক্স’ প্রকাশ করেছে। বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই সূচককে মূল্যায়ন করেন। হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের বৈশ্বিক পাসপোর্ট সূচক ২০২৫-এ বাংলাদেশের পাসপোর্টও ১০৬টি দেশের মধ্যে ১০০তম অবস্থানে নেমে যায়।
দেশি বা বিদেশি যে কোনো বিনিয়োগকারী দীর্ঘ মেয়াদে তার বিনিয়োগের নিশ্চয়তা চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। না পেলে তারা পিছিয়ে যাবেন। অথচ ১৮ কোটি মানুষের এই দেশে ব্যাপক বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই বিনিয়োগের জন্য দ্রুত আস্থার পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের প্রথম শর্তই হচ্ছে কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর। অনেক সময় বিনিয়োগকে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে ধরা হয়। বিনিয়োগ ব্যক্তি খাতে যেমন হতে পারে, তেমনি হয় রাষ্ট্রীয় খাতে। যে কোনো দেশে ব্যক্তি বা বেসরকারি বিনিয়োগ বড় একটা দিক। দেশের অর্থনীতি নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। ছোটবড় সব ব্যবসার ক্ষেত্রেই নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগ- সবকিছুই যেন তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
শেখ হাসিনার সরকার ও তার আত্মীয়স্বজন মিলে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। ব্যাংকের টাকা লোপাট করেছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে শেষ করে দিয়েছে। গণ অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর তার ধ্বংস করে যাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করে যাচ্ছে। পর্যুদস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজ সহজ নয়। তবে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তাদের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে তা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। রিজার্ভ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে পারলেও বেসরকারি বিনিয়োগের পরিবেশ ও নিত্যপণ্যের মূল্য এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে কীভাবে বিনিয়োগে তাদের উদ্বুদ্ধ করা যায়, এ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা সরকারকে নিতে হবে। এ সরকারের সময় যদি বিনিয়োগ বাড়ানো না যায়, মানুষ ভালো না থাকে, তাহলে তা হবে হতাশার। কারণ এ সরকারে দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা রয়েছেন। অন্যরা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছেন। তাদের সমন্বয়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব বাধা ও সংকট রয়েছে, তা উত্তরণের পথরেখা তৈরি সম্ভব। বিনিয়োগের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসে, অনিশ্চয়তায় না ভোগে। পরবর্তী সরকার এলেও যাতে তাদের বিনিয়োগ ইনটেক্ট থাকে এবং এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য