সাম্প্রতিককালে বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড স্মরণকালের ভয়াবহ মর্মান্তিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে অনেক নিষ্পাপ মানুষ। হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় কাতরাচ্ছে আরও অনেকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ। যারা এমন ভয়াবহ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় তাদের শহীদ বলা হয়। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়ার বাইরে আরও সাত প্রকার মানুষ শহীদ হিসেবে গণ্য হয়, যে প্লেগে (মহামারি) মারা যায়, যে পানিতে ডুবে মারা যায়, যে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়, যে পেটের মহামারিতে মারা যায়, যে আগুনে পুড়ে মারা যায়, আর যে নারী সন্তান প্রসবকালে মারা যায় সে শহীদ (আবু দাউদ)।’
সব ধরনের বিপদ, দুর্ঘটনা, অসুস্থতা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা, আকস্মিক মৃত্যু, হৃদয়বিদারক করুণ কাহিনি, বিশ্ববাসীর জন্য এক মহাসতর্কবার্তা। প্রত্যেক ইমানদার মানুষের কর্তব্য যাবতীয় বিপদে ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা। আল্লাহ যা করেন এতে আমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, মুমিনের বিষয় খুব তাৎপর্যপূর্ণ, তার সব বিষয়ে কল্যাণ জড়িত। মুমিন ব্যতীত অপর কারও জন্য এমন নয়। মুমিনের যখন অভাব আসে তখন সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এতে তার কল্যাণ বৃদ্ধি পায়। যখন তার বিপদ আসে তখন সে ধৈর্য ধারণ করে, এতে তার কল্যাণ বৃদ্ধি পায়। অপর হাদিসে রসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমান যে কষ্টে, ক্লান্তিতে, রোগে, দুশ্চিন্তায়, বিষাদে ও দুঃখে আক্রান্ত হয়, এমনকি পায়ে বিঁধে যাওয়া একটি কাঁটাও, তা দ্বারা আল্লাহ তাঁর গুনাহসমূহ মাফ করে দেন (বুখারি, মুসলিম)।’
যাদের আত্মীয়স্বজন মারা যায়, অর্থসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের জন্য বিষয়টা খুবই কষ্টকর। ধৈর্যধারণ করা একটি অসম্ভব বিষয়। তবে এর পুরস্কারও অনেক বড়। হবে বিনিময়ের মাধ্যম। ইসলামের দৃষ্টিতে অগ্নিকাণ্ড একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনাই নয়, বরং তা অনেক সময় মানুষের কর্ম ও অবহেলার কারণে সতর্কবার্তা হয়ে থাকে। অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, তওবা করা ও দান সদকা করা বিশেষ কর্তব্য বিষয়। আর বাহ্যিকভাবেও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। রসুল (সা.) ঘুমানোর আগে আগুন নিভিয়ে ঘুমানোর নির্দেশনা দিয়েছেন (বুখারি, মুসলিম)।
সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কথা হলো, সবার জন্য মরণ আসবে, নির্ধারিত সময়ে আসবে। কার মরণ কীভাবে, কোথায় হবে তা কারও জানা নেই। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু’ (আলে ইমরান-১৮৫)। কারও মৃত্যু নির্দিষ্ট সময়ের আগে হবে না, হবে না একমূহূর্ত পরেও। আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একটি মেয়াদ রয়েছে, যখন তাদের মেয়াদ এসে যাবে তখন তারা একমূহূর্ত পিছে যেতে পারবে না এবং তারা এগিয়েও আসতে পারবে না’ (আল আরাফ-৩৪)। আল্লাহর নির্দেশে প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে মানুষের মধ্যে বাহ্যিক কিছু লক্ষণ দেখা যায়। কেউ বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যায়, অসুস্থতায় অনেকে মারা যাচ্ছে। অনেকে মারা যাচ্ছে কোনো লক্ষণ ছাড়াই। সাম্প্রতিককালে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণে। সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হঠাৎ করে রহস্যজনকভাবে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। সড়ক দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প, বজ্রপাত ইত্যাদি কারণে আকস্মিক মৃত্যুর মিছিল বর্তমানে নিত্যদিনের খবর। আকস্মিক মৃত্যু থেকে পরিত্রাণের জন্য রসুল (সা.) আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমান যদি অন্য কারও জন্য কিছু অসিয়ত করার মতো (পাওনা) থাকে, তাহলে অসিয়তনামা লিপিবদ্ধ না রেখে দুই রাত অতিক্রম করার অধিকার তার নাই (সহিহ বুখারি)।’
দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো, মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। যাতে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করে, যাতে তারা ফিরে আসে (সুরা আর রুম-৪১)।’ একজন মানুষের মরণকালে এবং এর পরবর্তী ধাপে তার জন্য বিভিন্ন করণীয় রয়েছে। ইসলাম ধর্মে এসব কাজ পরম আদর্শপূর্ণ। মৃত ব্যক্তির প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের পরিচায়ক।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা