সভ্যতার শুরু থেকেই সেবার মানসে একক বা সমমনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সংঘ বা সমিতি। ফলে সেবার সম্বল এবং সেবা সরবরাহের শক্তি, সক্ষমতা গড়ে ওঠে, যা ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর হয়। এই সম্প্রসারণের গ্রহণযোগ্যতা, স্বয়ংক্রিয়তা থাকে। ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদ (সা.) যিনি তাঁর সমাজে আল আমিন হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তাঁর বিরোধিতাকারীরাও তাঁর কাছে সম্পদ জমা রাখত। আমানত রাখত। তিনি কারও আমানত খেয়ানত করেছেন এমন সংবাদ ইতিহাসে নেই। তাঁর উদ্যোগে যে সমিতি গড়ে উঠেছিল তার নাম ‘হিলফুল ফুজুল’।
দেশে বর্তমানে লাখ লাখ সংঘসমিতি আছে যেগুলোর সরকার তো দূরে থাক ইউনিয়ন পরিষদেরও স্বীকৃতি নেই। এর অধিকাংশ ভালো কাজে যুক্ত থাকলেও কিছুসংখ্যকের খারাপ কাজের কারণে তাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে না। প্রত্যেক দেশের সরকার বর্তমানে তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ সম্ভাবনাময় উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিতে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। স্বীয় নীতিমালার সুফল ভালোই হয়েছে। জিও কর্তৃক যেসব সংঘসমিতিকে স্বীকৃতির নিবন্ধন দেওয়া হয়, সেই সংঘগুলোকে এনজিও বা বেসরকারি সংস্থা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সম্পূর্ণরূপে স্বেচ্ছাসেবার শক্তিতে শুধু বলিয়ানই নয় মহাবলিয়ান হয়ে তৃণমূলে সমাজের উপেক্ষিত, দরিদ্র, অধরা ব্যক্তিদের প্রেরণার দ্বারা ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমাজসেবা বিভাগের নিবন্ধন নিয়ে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের যাত্রা শুরু। এরকম সংস্থা, সংঘ বাংলাদেশে অসংখ্য আছে। যাদের সততা, শুদ্ধাচার, উন্নয়নের অগ্রযাত্রার মূল ভিত স্বেচ্ছাসেবা। আমি অশোকা ফাউন্ডেশনের আকর্ষণীয় বৃত্তি নিয়ে পাঁচ বছর এনজিও অনুসন্ধানে তাদের স্বেচ্ছাসেবার সুফল পর্বততুল্য পরিমাণ অনুভব করেছি। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবা তলানিতে। আমার ধারণা, এর অন্যতম কারণ সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া নিয়মনীতি, চাকরিবিধি, কাঠামোগত বেতনস্কেল, পদপদবি, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি। এগুলো এনজিও ব্যক্তিত্বদের জিওতুল্য আমলার আমিত্ব সতেজ করে স্বেচ্ছাসেবাকে সহায়তা করছে। সরকারের রেগুলেশন না থাকায় কোনো কোনো তুচ্ছ এনজিওর প্রধানরা নাকি মাসিক ১০-১৫ লাখ টাকা বেতনভাতাদি নেওয়া ছাড়াও সমপরিমাণ অর্থের সুযোগসুবিধা ভোগ করছেন। তাই এনজিওকে নীতির বেড়াজালে নেতিয়ে ফেলা ছাড়া সরকার উপায় দেখছে না।
করোনাভাইরাসের ফলে বিশ্ব শাটডাউনের সঙ্গে বাংলাদেশও শাটডাউনে ছিল। এনজিওরা যেসব ব্যাংকের কাছ থেকে মূলধন নিয়েছিল তাদের সুদের সক্রিয়তা, কিস্তির কটকটানি শাটডাউন তো দূরে থাক ছাড়, সাহায্য, সহানুভূতির বিন্দুমাত্রও ছিল না। সুদে-আসলে ব্যাংকগুলোকে ষোলো আনাই ফেরত দিয়েছে। এদিকে তৃণমূলের বিধ্বস্ত পরিবারগুলোর বকেয়া ফেরত দেওয়ার সামান্য শক্তিও নেই। তাই মাফ করতে হয়েছে, ছাড় দিতে হয়েছে কিন্তু ষোলো আনা বুঝে পাওয়া ব্যাংকগুলো বাঁচতে পারেনি। ডিপেনডেন্ট, ইনডিপেনডেন্ট ব্যাংক সদস্যের বৃহত্তর মজবুতি কাঠামো, সরকারি নীতি ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করতে সহায়তা বৈকি সুস্থ করেনি। রুগ্ণ ব্যাংকের আমল এবং আইন ধরে সরকার স্বেচ্ছাসেবাসমৃদ্ধ এনজিও-এমএফআইগুলোর প্রতি অনুশাসন করতে চাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর মালিক আছে, শেয়ারহোল্ডার আছে। এনজিওর কোনো মালিক নেই, শেয়ারহোল্ডারও নেই। এনজিওর মালিক সদস্য, সমাজ, সরকার। শুধু প্রতিনিধিত্ব করেন উদ্যোক্তা, কর্মকর্তা, জনবল। এরূপ ভিন্নধর্মী সংস্থার জন্য স্বতন্ত্র সদস্য বা পরিচালকের আবশ্যকতা দেশের কোনো এনজিওই বোঝে না। যাদের দ্বারা উদ্যোগ, আয়োজন সৃষ্টি, তাদের বোধগম্যহীন নীতি চাপিয়ে দিয়ে ব্যাংকগুলোর মতো এমএফআইগুলোকেও ফোকলা করে বাংলাদেশের তৃণমূল অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়ে সরকার কার স্বার্থ রক্ষা করবে, এটাও বোধগম্য নয়।
ব্যাংকের বোর্ডে যারা আছেন তারা মালিক কিন্তু মালিকানার অনুভূতি নেই। অর্থাৎ তারা ব্যাংকের মালিক কিন্তু মালিকানার মর্ম, মহত্ত্ব বোঝেন না। অন্যদিকে এনজিও-এমএফআইএর বোর্ডে যারা আছেন, তারা মালিক নন কিন্তু মালিকানার অনুভূতি আছে, মানে মালিকানা নেই কিন্তু মালিকানার মোহ, মহত্ত্ব দিয়ে মায়া করেন। স্বেচ্ছাসেবার মনমানসিকতা দিয়ে এই সেক্টরকে সক্রিয় রেখে চলেছেন। এই মহামূল্যবান সম্পদকে অবজ্ঞা করলে সর্বনাশ হবে, দরিদ্রদের মাত্রা বেড়ে যাবে; বেকারত্ব, অন্যায়, অপরাধ বেশুমার হবে। এনজিও-এমএফআইগুলো কর্তৃক তৃণমূলে অর্থপ্রবাহের পাশাপাশি সচেতনতা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়নের প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের উদ্যোগগুলো সফল করার জন্য বাড়িবাড়ি, খেতেখামারে, ফ্যাক্টরিতে উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনা দিয়ে তাদের আয় বৃদ্ধির নিশ্চয়তা করে এনজিও পাওনা পেয়ে থাকে। এজন্য সমপর্যায়ের ব্যাংকের তুলনায় এনজিওর জনবল প্রায় ১০ গুণ হয়ে থাকে। এনজিওর আর্থিক সেবার সমালোচকদের সুদের হারবিষয়ক অভিযোগ সরকার ও সমাজকে আমলে নিতে বলে। কিন্তু যা তারা বলে না করে না, সম-সুবিধার আওতায় সংস্থা চালিয়ে কম সুদ নিয়ে মডেল বানিয়ে এনজিওকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। তৃণমূল পর্যায়ের অনুশীলনকারী অভিজ্ঞদের ধারণা, সমাজ-দেশবিরোধী হয়তো বা কেউ কেউ দেশের তৃণমূল অর্থনীতি যেখানে মাটির উৎপাদন, ফসলাদি সক্রিয় রাখলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে নাকাল হবে না, ওপর অঞ্চলে যত দুর্নীতি, দুর্ঘটনাই হোক না কেন সরকারের দ্বারা তা টাঁকশালে টাকা ছাপিয়ে হলেও একটা ব্যবস্থা হবে। কিন্তু তৃণমূলে বিশাল সম্পদ স্বেচ্ছাসেবাকে সাপাট করে দিতে পারলে তৃণমূলের দুর্যোগ দূরীকরণে টাঁকশালে ছাপিয়ে টাকার প্রবাহ হবে না। বরং অর্থনীতির ভিত্তিমূলে গলদ ঘটবে। অর্থনীতি দুর্যোগের মধ্যে ঘুরপাক খাবে। তাই সরকারের উচিত দেশের মানুষের নিম্নগামী স্বেচ্ছাসেবাকে সমৃদ্ধ না করে স্বেচ্ছাসেবার সর্বনাশ হয়, ভঙ্গুর হয় এমন নীতি যেমন ব্যাংকগুলোকেও বাঁচাতে পারেনি, এনজিও-এমএফআইগুলোকেও রক্ষা করতে পারবে না। তাই ক্ষেত্র পর্যায়ের রেগুলেশনের ঘনত্ব বাড়িয়ে উদ্যোক্তাদের উদ্যোগের প্রতি সেবার মালিকানাত্ব বৃদ্ধির সহায়ক না করলে আমও যাবে ছালাও যাবে। সে কারণে এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন, প্রসার ও গতিশীল কর্মপ্রবাহের স্বার্থে সরকারকে লাগসই ও সহায়ক নীতিকাঠামো প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে সংস্থাগুলো শক্তিশালী এবং তৃণমূলে জনগোষ্ঠীর অর্থনীতি মজবুত হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস