বাংলা সংগীতাঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম কুমার বিশ্বজিৎ। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ, আবেগভরা গানের বুনন এবং চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গানের জগতে নিরন্তর অবদান তাঁকে এনে দিয়েছে অগণিত শ্রোতার ভালোবাসা। একাধারে তিনি গায়ক, সুরকার ও সংগীত পরিচালক-তিন ভূমিকাতেই সমানভাবে সফল। বাংলাদেশি আধুনিক ও চলচ্চিত্র সংগীতের ইতিহাসে কুমার বিশ্বজিৎ এক অবিচ্ছেদ্য নাম।
বর্তমানে কুমার বিশ্বজিৎ গান গাওয়া কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন। তবে মাঝেমধ্যে নতুন গান কিংবা স্টেজ পারফরম্যান্সে তিনি এখনো হাজির হন। তাঁর গান নতুন প্রজন্মের কাছেও সমানভাবে সমাদৃত হচ্ছে, যা প্রমাণ করে ভালো সংগীত কখনো পুরোনো হয় না। এদিকে প্রায় আড়াই বছর তিনি স্টেজ শো থকে দূরে আছেন। কারণ, একমাত্র ছেলের অসুস্থতা।২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বপুত্র নিবিড় কানাডায় গাড়ি দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়। যে চিকিৎসা এখনো চলমান। এরপর গান থেকে অনেকটাই দূরে সরে যান কুমার বিশ্বজিৎ। এমনকি স্টেজ শো থেকেও নিজেকে সরিয়ে রাখেন। পুত্রের চিকিৎসার জন্য পুরো সময়টা তিনি স্ত্রীসহ কানাডাতেই বসবাস করছেন। তবে কুমার বিশ্বজিৎভক্তদের জন্য সুখবর, আবার নতুন গান ও স্টেজ শোতে ফিরছেন এ সংগীতশিল্পী।
কুমার বিশ্বজিৎ জানিয়েছেন, কানাডার টরন্টো থেকে তাঁর স্টেজ শো শুরু হতে যাচ্ছে। এরপর প্যারিস, নিউজিল্যান্ড, কাতার এবং অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে দলবল নিয়ে স্টেজ শো করবেন। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন ধরে আয়োজকেরা চাইছিলেন, দেশে ও দেশের বাইরের স্টেজ শোতে ফিরি। কিন্তু মানসিক অবস্থা এমন ছিল যে, কোনোভাবে ইচ্ছা করছিল না কোথাও গাওয়ার। গান তো ইমোশন দিয়ে করার ব্যাপার, সেই ইমোশন সত্যি বলতে কাজ করছিল না। এর মধ্যেও অনুরোধে গত দুই বছরে দু-একটা শো করতে হয়েছে। এখন যেহেতু নিবিড়ের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে, তাই টানা কয়েকটি স্টেজ শোতে পারফর্ম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নতুন কয়েকটি গান নিয়েও পরিকল্পনা চলছে।’ তিনি জানিয়েছেন, আগামী ২২ জুন কানাডার টরন্টোতে একটি কনসার্টে গাইবেন। এমনকি জুলাইতে প্যারিসে কনসার্ট করবেন। নিউজিল্যান্ডেও কনসার্ট নিয়ে কথা চলছে। আগস্টে অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কয়েকটি কনসার্ট করবেন। এ ছাড়া ২৩ আগস্ট মেলবোর্নে, ৩০ আগস্ট সিডনিতে, ৩১ আগস্ট ব্রিসবেনে এবং ৬ সেপ্টেম্বর পার্থে গাইবেন তিনি।
চট্টগ্রামের এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা কুমার বিশ্বজিতের সংগীতজীবনের শুরু হয়েছিল আশির দশকে ব্যান্ড ‘ফিডব্যাক’-এর মাধ্যমে। তবে একক ক্যারিয়ারেই তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তাঁর কণ্ঠে গাওয়া ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘তুমি রোজ বিকেলে’, ‘যদি তুমি বল’ কিংবা ‘চন্দনা’-এসব গান যেন সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে।
কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে রয়েছে এক অভিজাত সৌন্দর্য, যা শ্রোতাকে শুধু বিনোদন দেয় না, মুগ্ধ করে, ভাবায়। তিনি এমন এক শিল্পী যিনি গানে প্রাণ দেন, অনুভব ছড়িয়ে দেন প্রতিটি সুর ও কথায়। আধুনিক গানের পাশাপাশি তিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রেও প্লেব্যাক করেছেন, যার মধ্যে অনেক গানই সুপারহিট হয়েছে এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেছেন। শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের গানের বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি কোনো গানকে কেবল গেয়ে শেষ করেন না, তাঁর গাওয়া প্রতিটি গান যেন এক একটি গল্প। তাঁর গায়কিতে যে আবেগ, তা বাংলা গানের ভান্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। তিনি নিজেই বহু গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন, যা প্রমাণ করে তাঁর প্রতিভার পরিধি কত বিস্তৃত।
কেবল সংগীতেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি একজন অনন্য রুচিসম্পন্ন মানুষ। মিডিয়া হতে দূরে থেকেই নীরবে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব জগৎ। তরুণ শিল্পীদের উৎসাহ দেওয়া, ভালো সংগীতের পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং সংগীতের মান ধরে রাখার প্রয়াস তাঁকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। বাংলা সংগীতজগতে কুমার বিশ্বজিতের মতো শিল্পী বিরল। তিনি প্রমাণ করেছেন গানের আসল শক্তি সুরে নয়, অনুভবে। তাঁর গানে আমরা যেন জীবনের ভালোবাসা, বিরহ, আনন্দ আর ব্যথার স্পর্শ পাই। কুমার বিশ্বজিৎ কেবল একজন সংগীতশিল্পী নন, তিনি বাংলা গানের আত্মা হয়ে উঠেছেন।