‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’- যার কণ্ঠে লালন সাঁইয়ের গান মানুষের মনকে ছুঁয়ে গেছে প্রায় ছয় দশক ধরে, যিনি হয়ে উঠেছিলেন লালনের গানের সমার্থক, সেই সংগীতশিল্পী হলেন ফরিদা পারভীন। তিনি ইহজগতে আর নেই। জাগতিক সব সম্পর্ক ছিন্ন করে পাড়ি দিয়েছেন অচিন দেশে। লোকসংগীতের বরেণ্য এ শিল্পী গত শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে মারা যান। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তাঁর জীবনের নানা চিত্র তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ
যেভাবে লালন গানে...
বাংলাদেশের লালনসংগীতের সঙ্গে ফরিদা পারভীনের নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন গানে গানে কাটিয়েছেন প্রায় ৬ দশক। ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীনের পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে কুষ্টিয়ার দোলপূর্ণিমার মহাসমাবেশে প্রথমবারের মতো লালনের গান পরিবেশন করেন। সেই গান ছিল- ‘সত্য বল সুপথে চল’। শ্রোতার আবেগ, উচ্ছ্বাস আর প্রশংসা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এ পথেই তাঁর যাত্রা করতে হবে। শুরুতে অনীহা থাকলেও বাবার উৎসাহে গুরু মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে লালনের গান শেখা শুরু করেন। এরপর খোদাবক্স সাঁই, করিম সাঁই, ব্রজেন দাসসহ গুরু পরম্পরার সাধকদের কাছে তালিম নিয়ে লালনের গানকে তিনি কণ্ঠে ধারণ করেন। তাঁর কণ্ঠে লালনের গান হয়ে ওঠে শুধু সংগীত নয়, এক অনন্য জীবনদর্শন। তিনি বলেছিলেন, শ্রোতাদের বলি, ‘আমি একটি গান গাইতে শিখেছি। এটাই ভালোভাবে গাইতে চাই।’ এ গানই আমার নতুন পথের দিশা হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি, কী আছে লালনের গানে। তাঁর গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিক কথা ও দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে। একপর্যায়ে অনুভব করি, লালন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনবদ্য এক স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। এটা বোঝার পর লালনের গান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।’
লালন গানের অগ্রভাগের শিল্পী-
লালনের গান গেয়ে দেশ-বিদেশে খ্যাতি কুড়ানো যেসব শিল্পী আছেন তাঁদের সবার অগ্রভাগে অবস্থান করেন এ বরেণ্য প্রয়াত লালনসংগীত শিল্পী। যিনি লালনকন্যা হিসেবেই পরিচিত। বিবিসি জরিপে যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান নির্বাচিত করেছে তার মধ্যেও আছে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের গান। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ নামের এ গানটি বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ গানের অন্যতম একটি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। লালনসংগীত ছাড়াও আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। শুরুতে নজরুল সংগীতশিল্পী হিসেবে যাত্রা করলেও পরে পল্লীগীতিতে তাঁর কণ্ঠ অসাধারণ দরদি হয়ে ওঠে। সেদিক থেকেও তিনি মূলত পল্লীগীতি শিল্পীই।
যেভাবে গানে হাতেখড়ি-
ফরিদা পারভীনের গানে হাতেখড়ি পাঁচ বছর বয়সে। রাজশাহী বেতারে নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন ১৯৬৮ সালে। এরপর ১৯৭৩ সালে তিনি কণ্ঠে তুলে নেন লালনের গান। লালন ফকিরের ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান দিয়েই লালনের গানে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। গুরু মকছেদ সাঁইয়ের অনুরোধে স্বাধীনতা পরবর্তী কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে দোলপূর্ণিমার উৎসবে তিনি প্রথম এ গানটি করেন।
বিশ্বদরবারেও লালন নিয়ে-
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বদরবারেও তিনি লালন সাঁইয়ের বাণী ও সুর প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরও বহু দেশে লালনসংগীত পরিবেশন করেছেন তিনি। ‘লালনসম্রাজ্ঞী’ ফরিদা পারভীন। দেশ-বিদেশে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন লালনের বাণী। তাঁর কণ্ঠে দেশ- বিদেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালনসংগীতে মুগ্ধ। সবখানেই তাঁর কণ্ঠে বেজেছে লালনের দর্শন। ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ কিংবা ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ শোনেননি এমন শ্রোতার সংখ্যা খুবই কম। তাঁর মতে, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি থেকে লালনচর্চার কোনো বিকল্প হতে পারে না।
ঘটনাবহুল জীবন...
ফরিদা পারভীনের রক্তে ছিল গান। দাদি গান করতেন, বাবার ছিল গানের প্রতি অনুরাগ। ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে কিশোরী ফরিদা শুরু করেছিলেন পেশাদার সংগীতজীবন। সেই থেকে শুরু, গত শনিবার শেষ হলো তাঁর ৫৫ বছরের সংগীতজীবন। ফরিদা পারভীন ছোটবেলায় ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। প্রায় সারাক্ষণ দৌড়ঝাঁপ আর খেলাধুলায় মেতে থাকতেন। দাদা ও নানাবাড়ির মাঝখানে ছিল এক নদ। আত্রাইয়ের সেই শাখা নদের নাম ছিল গুর। ওই নদ পার হয়ে তরুণী ফরিদা দাদার বাড়ি থেকে নানার বাড়ি যেতেন। নানার বাড়ির পাশে বিরাট এক বিল ছিল। শৈশবে খেলার সঙ্গী মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে সেই বিলে শাপলা তুলতে যেতেন। ফরিদার শৈশবের সময়টা তাঁর কেটেছে মাগুরায়। স্কুলজীবনের শুরুটাও সেখানে। সে সময় ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে তার সংগীতে হাতেখড়ি। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা হয়েছে তাঁর। পড়তে হয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুলে। পরে দীর্ঘদিন কুষ্টিয়া শহরে ছিলেন ফরিদা। কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে স্নাতক। ওই শহরেই দীর্ঘদিন তিনি চর্চা করেছেন লালনগীতির। শৈশব থেকেই ফরিদা পারভীনের পছন্দ ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীন রাজশাহী বেতারে নজরুলশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর লালনসংগীতের সঙ্গে তাঁর আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়। তখন তিনি কুষ্টিয়ায়। সেখানে তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মকছেদ আলী সাঁই।১৯৭৩ সালে ফরিদা পারভীন তাঁর কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটি শিখে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন। মকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালনসংগীত শেখেন তিনি। এরপর মগ্ন হন লালনসংগীতে।
পারিবারিক জীবন
ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী প্রখ্যাত গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর। সেই সংসারে তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরি উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী বাঁশিশিল্পী গাজী আবদুল হাকিম।
যেভাবে লালনসম্রাজ্ঞী
লালন সাঁইজির গানের বাণী ও সুরকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। তাঁর মতে, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি থেকে লালনচর্চার কোনো বিকল্প হতে পারে না। তিনি লালনের জীবন ও দর্শনকে গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন এবং তাঁর গানের মাধ্যমে সেই জীবন দর্শনকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। লালনসংগীতের বাণী ও সুরের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন এ লোক সংগীতশিল্পী। কখনোই লালনের গানগুলোর বিকৃতি ঘটাননি, বরং এর মৌলিকতা ও গভীরতা বজায় রেখেছেন, যাঁকে ‘লালনসম্রাজ্ঞী’ উপাধি অর্জনে ভূমিকা রাখে।
জনপ্রিয় যত গান
তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা’, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে’, ‘খাঁচার ভিতর’, ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ ইত্যাদি। তাঁর অ্যালবামের মধ্যে রয়েছে- ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ‘অচিন পাখি’ নামে একটি লংপ্লে, ডন কোম্পানি থেকে ‘লালনগীতি’, সারগাম থেকে ‘লালনের গান’, দোয়েল প্রোডাক্টস থেকে ‘দেশাত্মবোধক/আধুনিক/ লালন’ মিলে একটা ক্যাসেট আরশিনগরের ব্যানারে লালনের গান ‘আমারে কি রাখবেন গুরু চরণে’, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, আবুল উলাইয়ার পরিবেশনায় ‘আশা পূর্ণ হলো না’, ‘লাইভ কনসার্ট ইন জাপান’। তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাব না সমুদ্রের কলেতে বসে, হিট সংস অব ফরিদা পারভীন : মিলেনিয়াম বহুদিন হলো ভেঙেছি ঘর’, ‘লাইভ কনসার্ট ইন ফ্রান্স’।
যত সম্মাননা
সংগীতে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে ফরিদা পারভীন একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ সিনেমায় ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তিনি ২০০৮ সালে জাপানের সম্মানসূচক ফুকুওয়াকা পুরস্কার লাভ করেন।
ফরিদা পারভীন প্রজেক্ট
২০০১ সালে ‘ফরিদা পারভীন প্রজেক্ট কমিটি’র উদ্যোগে তিনি জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লালনের গান পরিচয় করিয়ে দেন। পরে গড়ে তোলেন ‘ফরিদা পারভীন ট্রাস্ট’, যার লক্ষ্য ছিল লালনের গান সংরক্ষণ, স্বরলিপি তৈরি এবং বাদ্যযন্ত্রের আর্কাইভ তৈরি করা। তার উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় অচিন পাখি স্কুল, যেখানে শিশুদের শেখানো হয় আধ্যাত্মিক শক্তির মর্ম ও গান।
হিন্দি ভাষায় শিল্পীর লালনসংগীত
২০১৭ সালে হিন্দি ভাষায় গাওয়া লালনসংগীত নিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ করেন ফরিদা পারভীন। ডিভিডি আকারে প্রকাশ পাওয়া এ অ্যালবামে ছিল ফকির লালন সাঁইয়ের কালজয়ী ২০টি গান। অ্যালবামের নির্বাচিত গানগুলো হিন্দি ভাষায় অনুবাদ করেছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন সাবেক হাইকমিশনার অধ্যাপক মুচকুন্দ দুবে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে মুচকুন্দ দুবের লেখা ‘লালন শাহ ফকির কি গীত’ বইয়ের সঙ্গে ফরিদা পারভীনের ডিভিডির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এটি মূলত স্মারক অ্যালবাম, যা তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর আগেও হিন্দি ভাষায় লালনসংগীত গেয়েছেন ফরিদা পারভীন। আশির দশকে হিন্দি ভাষায় গাওয়া লালনসংগীত নিয়ে একটি অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছিল।
সুইডেনের রানি অশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন
ফরিদা পারভীনের সুইডেন সফরের একটি ঘটনা আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। যেখানে সেদেশের রানি তাঁর গান শুনে অশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি কথাগুলো বুঝি না, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে যে বেদনা আছে, তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।’ সংগীতজীবনে ফরিদা পারভীনের অনেক স্মরণীয় স্মৃতি আছে। সেরকম একটি ঘটনার কথা জীবদ্দশায় তিনি এভাবেই বলেছিলেন- ‘১৯৭৩ সাল। বিভিন্ন আখড়া থেকে বাউলশিল্পীদের ঢাকায় এনে লালনের গান রেকর্ডের পরিকল্পনা করেন ওস্তাদ মকছেদ আলী সাঁই। তিনি তৎকালীন রেডিওর ট্রান্সক্রিপশনে কর্মরত ছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে ঢাকায় রেডিওতে আসি। এ সময় স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন আবদুল হামিদ চৌধুরী, কমল দাশগুপ্ত, সমর দাস, কাদের জমিলির মতো বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞরা। খুব ভয় হয়েছিল। তাঁদের সামনে আমাকে গাইতে হলো। ১৫ মিনিটের একক সংগীতানুষ্ঠান করে তাঁদের প্রশংসা পেয়েছিলাম। এটিই আমার অন্যতম স্মরণীয় স্মৃতি।’