বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। আমার জন্মদিনে বিশেষ আয়োজন নাকি করবে তারা। আমাকে বলল, একটি লেখা দিতে। কিন্তু কি লিখি নিজের সম্পর্কে? কলম ধরে ভাবনার সাগরে ডুব দিলেই আমি শুধু অতীত কাতর হয়ে যাই।
ছোটবেলায় ভীষণ ডানপিটে ছিলাম। খেলার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। ফুটবল খেলতাম। এলাকায় গোলকিপার হিসেবে বেশ সুনাম ছিল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার জীবনে অভিনয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ আসে। কলকাতার থানপুর হাইস্কুলে পড়তাম। প্রতি বছর সরস্বতী পূজার সময় নাটক মঞ্চস্থ হতো। ক্রীড়া শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমাকে বেছে নেন নায়ক হিসেবে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক 'বিদ্রোহী'। এ নাটকে আমার অভিনয় প্রশংসিত হওয়ার পর ঝুঁকে পড়ি নাটকের প্রতি। আমার নাট্যগুরু পীযূষ বোস তার শিশু রঙ্গসভায় আমাকে সদস্য করে নেন। তারপর একের পর এক অভিনয় চালিয়ে যাই। যেহেতু রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলাম, তাই কিছুটা পারিবারিক বাধাও আসে। আমার মেঝ ভাই আবদুল গফুর আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, যদি ভালো করতে পার কোনো অসুবিধা নেই। মূলত তার প্রেরণায়ই আমি আজ অভিনেতা। থানপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে চারুচন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই। কলেজে পড়ার সময় 'রতনলাল বাঙালি' ছবিতে প্রথম অভিনয় করি। ১৯৫৯ সালে মুম্বাই গিয়ে ভর্তি হই 'ফিল্মালয়ে'। কলকাতায় 'পংকতিলক' ও 'শিলালিপি' নামে আরও দুটি ছবিতে অভিনয় করি। অভিনয়, পড়াশোনা আর পারিবারিক ব্যবসায় ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় খেলাধুলা আর ধরে রাখতে পারিনি। ১৯৬১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে খেলায় ইস্তফা দেই।
টালিগঞ্জ ফিল্মপাড়া আর আমাদের বাড়ি একই জায়গায়। ছোটবেলা থেকে কাননদেবী, বসন্ত চৌধুরী ও ছবি বিশ্বাসদের দেখে দেখে বড় হয়েছি। তাদের জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে তাদের মতো বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আমার নাট্যগুরু পীযূষ বোস পরে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে খ্যাতি পান। এরই মধ্যে বেশক'টি ছবিতে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেছি। তখন আমি অভিনয়ে প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এরই মধ্যে ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা বেধে যায়। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। পরিবারের প্রায় সবাই মির্জাপুর চলে যায়। আমি মুম্বাই যাব বলে ভাবছি। আমার গুরু মুম্বাই যেতে নিষেধ করলেন। সেখানে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা। তিনি বললেন, তার চেয়ে তুমি পূর্ব পাকিস্তান চলে যাও। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম। আট মাসের বাপ্পাকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। এর আগে কোনো দিন ঢাকা বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসিনি। তেমন কাউকে চিনিও না। আবদুল জব্বার খানকে কিছুটা জানতাম। তিনি তার নির্মিতব্য 'উজালা' ছবির সহকারী পরিচালক হিসেবে আমাকে নিয়োগ দিলেন। সে সময়ের আরেক বিস্ময়কর চলচ্চিত্র প্রতিভা জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আশ্বাস দেন সময়-সুযোগমতো তার ছবিতে নেবেন। ১৯৬৮ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। তিনি তার 'বেহুলা' ছবিতে আমাকে নায়ক হিসেবে নেন। ছবিটি দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। সেই সঙ্গে আমাকেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দর্শক সানন্দে গ্রহণ করে।
আমি প্রায় ৫০০ ছবিতে অভিনয় করেছি। এর মধ্যে কমপক্ষে ৪০০ ছবিতে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছি। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছি। আর তাই অভিনয় করতে করতেই মৃত্যুর ইচ্ছা রাখি। এমনকি মৃত্যুর পরও কিছুটা বাস্তব দৃশ্য ধারণ করা হবে অভিনয়ের জন্য। 'দাফন-কাফন' নামে আমার জীবন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে, তার শেষ দৃশ্যের চিত্রায়ণ হবে আমার মৃত্যুর পর। আমার জীবনে অভিনয় শুধু পেশা বা নেশা নয়। আরও অনেক কিছু। অভিনয় থেকেই পরিচালনায় এসেছি। দেড় ডজনের মতো ছবি পরিচালনা করেছি। প্রযোজনা করেছি নিজের রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে সমসংখ্যক ছবি।
১৯৬২ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিয়ে করি। আমাদের মহল্লার খায়রুন্নেসাকে। আমি তাকে লক্ষ্মী বলে ডাকি। অভিনয় জীবনের ব্যস্ততায় আমি আমার সংসার, বাচ্চাদের দিকে তাকানোর সময় পাইনি। লক্ষ্মী গভীর মমতায় আগলে রেখেছে সব। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আমার যদি কোনো অবদান থেকে থাকে তবে তারও অবদান আছে এক নিবেদিতা মহিলা হিসেবে।
মানুষ আমাকে ভালোবাসে, আমার জন্য দোয়া করে- সম্ভবত সে জন্য আমি পারিবারিক জীবনেও সুখী। সন্তানদের নিয়ে বেশ ভালো আছি। তবে ছোট্ট একটা পারিবারিক কষ্টও আছে। আমার বড় মেয়ে শম্পা থ্যালাসেমিয়ায় মারা গেছে।
এক জীবনে পেয়েছি অনেক, দিতে পারিনি কিছুই। পুনর্জন্ম থাকলে, সবার জন্য কিছু করার চেষ্টা করব।