৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ১০:২৯
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

ভিন্নধারার ছবিই সেরা

আলাউদ্দীন মাজিদ

ভিন্নধারার ছবিই সেরা

নব্বই দশকের শুরু থেকেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মূলধারার মানে বাণিজ্যিক ছবির পরিবর্তে ভিন্ন ধারার মৌলিক গল্পের ছবিই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে আসছে। বৃহস্পতিবার ঘোষিত ২০১৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও ভিন্নধারার ছবির জয়জয়কার অব্যাহত রয়েছে।

চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মতে, সময়ের পথে হেঁটে নতুনদের কাঁধে ভর করে এ বদলের হাওয়া লেগেছে। দর্শকদৃষ্টি আকর্ষণ, জাতীয় পুরস্কার অর্জন ও আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রশংসা এবং সম্মাননায় এগিয়ে যাচ্ছে ভিন্নধারার ছবি। নব্বই দশকের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া এই চিত্র এখনো অব্যাহত। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা মাসুদ পথিকের মতে, উদ্ভট ও অবাস্তব গল্পের পরিবর্তে জীবনের গল্প নিয়ে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো নির্দ্বিধায় দর্শকগ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। আসলে আমাদের দেশে মৌলিক ও জীবনধর্মী গল্পের অভাব নেই। দর্শক চলচ্চিত্রে নিজের পারিপার্শ্বিকতাকে দেখতে চায়। আয়নায় আপন চেহারা দেখার মতো যখন ছবিতে নিজেদের চিরচেনা জীবনচিত্র খুঁজে পায় তখনই তারা সেই ছবি দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর তখনই ছবিটি সফল হয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়। এসব ছবিতে থাকে নিজ দেশের কৃষ্টি ও কালচারের জয়গান। আর এমন গল্পের ছবি বদলে দিচ্ছে দেশীয় চলচ্চিত্রকে। ১৯৯২ সালে নতুন ধারার গল্পের ছবি ‘শঙ্খনীল কারাগার’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ছবির মর্যাদা লাভ করে। এরপর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে সর্বশেষ ঘোষিত ২০১৯ সালের জাতীয় পুরস্কারে সেরা ছবি ও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভিন্ন ধারার গল্পের ছবিই সেরার মর্যাদা পেয়ে আসছে। ২০১৩ সালে সেরা ছবিসহ ২৫ ক্যাটাগরিতে ১৭টি পুরস্কার জিতে নেয় গাজী রাকায়েতের ‘মৃত্তিকা মায়া’। ২০১৪ সালের জাতীয় পুরস্কারেও ভিন্ন ধারার ছবি মাসুদ পথিকের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ শ্রেষ্ঠ ছবি নির্বাচিত হয়। সেরা নির্মাতার পুরস্কার জিতে নেন ভিন্নধারার ছবি ‘মেঘমল্লার’-এর জন্য জাহিদুর রহমান অঞ্জন। এ ছাড়া স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবি হিসেবেও ভিন্নধারার ছবি ‘গাড়িওয়ালা’ ২০১৪ সালের জাতীয় পুরস্কারে বিজয়ী হয়েছে। ২০১৫ সালের জাতীয় পুরস্কারে ২৫ ক্যাটাগরির মধ্যে সেরা ছবিসহ ১৭টি পুরস্কারই দখল করেছে ভিন্নধারার গল্পের চলচ্চিত্র। সেরা ছবি হিসেবে সম্মাননা পায় যৌথভাবে দুটি ছবি। এগুলো হলো- ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ ও ‘অনিল বাগচীর একদিন’। এ দুই ছবির নির্মাতা যথাক্রমে রিয়াজুল মওলা রিজু ও মোরশেদুল ইসলাম যৌথভাবে সেরা নির্মাতার পুরস্কারও জিতে নিয়েছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৬তে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হয় ‘অজ্ঞাতনামা’, শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঘ্রাণ’, শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘জন্মসাথী’, প্রযোজক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও একাত্তর মিডিয়া লিমিটেড।  শ্রেষ্ঠ পরিচালক : অমিতাভ রেজা চৌধুরী, আয়নাবাজি।  শ্রেষ্ঠ অভিনেতা প্রধান চরিত্র : চঞ্চল চৌধুরী, আয়নাবাজি। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী প্রধান চরিত্র : তিশা, ছবি- অস্তিত্ব ও কুসুম শিকদার, ছবি- শঙ্খচিল (যৌথভাবে)। এ ছাড়া টেকনিক্যাল বিভাগেও ভিন্নধারার ছবির পুরস্কার জয় করে নেয় প্রায় সব বিভাগে। ২০১৭ সালের সেরা ছবির পুরস্কার পায় দীপংকর দীপনের ‘ঢাকা অ্যাটাক’ আর ২০১৮ সালে সাইফুল ইসলাম মান্নুর ‘পুত্র’। ‘গহীন বালুচর’ ছবির জন্য ২০১৭ সালের সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান বদরুল আনাম সৌদ আর ২০১৮ সালের ‘জান্নাত’ ছবির জন্য মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া এই দুই বছর ভিন্নধারার ছবিই জাতীয় পুরস্কারের বেশির ভাগ ক্যাটাগরি দখল করে নেয়।

২০১৯ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছে মাহবুব উর রহমানের ‘ন ডরাই’ ও ফরিদুর রেজা সাগরের ‘ফাগুন হাওয়ায়’। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা তারিক আনাম খান (আবার বসন্ত) এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী সুনেরাহ বিনতে কামাল (ন ডরাই)। এ ছাড়াও যারা এ সম্মানজনক পুরস্কার  পেলেন তারা হলেন- শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক- তানিম রহমান অংশু (ন ডরাই),  শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেতা- ফজলুর রহমান বাবু (ফাগুন হাওয়ায়), শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেত্রী- নারগিস আক্তার (মায়া দ্য লস্ট মাদার), শ্রেষ্ঠ খলঅভিনেতা- জাহিদ হাসান (সাপলুডু), শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী- নাইমুর রহমান আপন (কালো মেঘের ভেলা) ও আফরিন আক্তার (যদি এক দিন), শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক- মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ইমন (মায়া দ্য লস্ট মাদার), শ্রেষ্ঠ নৃত্য পরিচালক- হাবিবুর রহমান (মনের মতো মানুষ পাইলাম না), শ্রেষ্ঠ গায়ক- মৃণাল কান্তি দাস (তুমি চাইয়া দেখ), (শাটল ট্রেন), শ্রেষ্ঠ গায়িকা- মমতাজ বেগম (বাড়ির ওই পূর্বধারে...) এবং ফাতিমা তুয যাহরা ঐশী (মায়া দ্য লস্ট মাদার), শ্রেষ্ঠ গীতিকার- নির্মলেন্দু গুণ (ইস্টিশনে জন্ম আমার), (কালো মেঘের ভেলা) এবং কবি কামাল চৌধুরী (চল হে বন্ধু চল), (মায়া দ্য লস্ট মাদার), শ্রেষ্ঠ সুরকার- প্লাবন কোরেশী (বাড়ির ওই পূর্বধারে) এবং সৈয়দ মো. তানভীর তারেক (আমার মায়ের আঁচল), (মায়া দ্য লস্ট মাদার)। এখানে উল্লেখ্য, ‘ন ডরাই’ ৫ ক্যাটাগরিতে এবং ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’ ৮ ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ ১০টি পুরস্কার জিতে নেয়। বাংলাদেশে প্রথম ভিন্নধারায় নির্মিত ছবি ‘আগামী’ নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। এটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। ছবিটি সব শ্রেণির দর্শক নজর কাড়ে। এরপর এ ধারার চলচ্চিত্রের সুদিন শুরু হয়। জুনায়েদ হালিম, তানভীর  মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, আবু সাইয়্যিদ, তারেক শাহরিয়ার, সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকি, মানজারে হাসান মুরাদ, নূরুল আলম আতিক, জাহিদুর রহমান অঞ্জন, সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড, সৈয়দা নিগার বানুর মতো নির্মাতারা এগিয়ে আসেন ভিন্নধারার গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে। তাদের হাতে ভিন্নধারার গল্পের ছবি সমৃদ্ধ হয়। গড়ে ওঠে ‘প্যারালাল সিনে মুভমেন্ট’ শিরোনামের একটি সংগঠন। পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক প্রশংসায় ভিন্নধারার ছবি সিক্ত হয়। এক্ষেত্রে সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ডের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। কারণ তাঁর নির্মিত নাচোলের রানী, গঙ্গাযাত্রা, অন্তর্ধান, প্রতিটি ছবিই দেশ-বিদেশে উচ্চ শ্রেণির দর্শকের মর্যাদা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে। এই নির্মাতার ‘শেষ কথা’ ছবিটিও দর্শক প্রশংসা কুড়িয়েছে। তা ছাড়া অন্য নির্মাতাদের ভুবন মাঝি, জালালের গল্প, অজ্ঞাতনামা, ভয়ংকর সুন্দর, আয়নাবাজি, ডুব হলো দর্শক আগ্রহ বদলে দেওয়া ভিন্নধারার ছবি।

কয়েকটি বিদেশি পত্রিকা বাংলাদেশের তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তাদের নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রশংসা করে প্রতিবেদন ছেপেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বলিউড বা হলিউড কিংবা অন্য কোনো দেশের চলচ্চিত্রকে অনুকরণ না করে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা গল্প বলার ক্ষেত্রে নিজস্ব ভঙ্গি তৈরি করেছেন। পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডেইলি স্ক্রিন’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল ‘বাংলা চলচ্চিত্রের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে।’ এতে বলা হয়, বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প বলছে। দিন বদলের আলো জ্বালাতে শুরু করেছেন।  পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনে তরুণ চলচ্চিত্রকারদেরও প্রশংসা করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দিন বদলের হাতিয়ার এখন তাঁদেরই হাতে। 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর