নীল ও আকাশের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে ০৫ লক্ষ টাকা দেনমোহরে। আমার অফিসের স্টাফদের জন্য বর ও কনেপক্ষ ০৪ কেজি মিষ্টান্ন এনেছে! আমরা চাই আকাশের মাঝে নীলা বিলীন হয়ে বিস্তৃত নীলাকাশ হয়ে উঠুক। বর ও কনের সুখী জীবনের প্রত্যাশা করছি।
(ঝড়ের কবলে নীলাকাশ ও তার মধুরেণ সমাপয়েৎ!)
ধরে নেই মেয়েটির নাম নীলা আর ছেলেটি আকাশ। খুব বেশিদিন নয় প্রায় ৭৩০ দিনের পরিচয়...কান্না বিজড়িত কণ্ঠে নীলার অফিসে আগমন। পছন্দের মানুষের সাথেই পরিবার বিয়ে করাতে সম্মত হয়েছেন। কোথায় মেয়ে খুশি হবে তা না হয়ে সে কাঁদছে!
আংটি বদলের পাঠ চুঁকে গেছে, হঠাৎ পরিণয়ের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আকাশের পরিবার! কিছু ক্রিয়া তার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া এবং তার পরিণতি- বিয়ে ভেঙে যাওয়া! আমাদের সমাজে বরপক্ষগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবধারিতভাবে কনেপক্ষের উপর এক ধরণের চাপ প্রয়োগ করতে চায়, সেটি বিবাহের আয়োজন, ০২ পক্ষের অতিথিগণের সংখ্যার হ্রাস বৃদ্ধিকরণ, বিবাহ পরবর্তী অপ্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতাসহ আরও নানা বিষয়ে। যার ফলে কনে পক্ষের শুধু বুক ফাঁটে কিন্তু মুখ ফোঁটে না! তাদের কান্না হয়ে যায় বোবা কান্না...
চুপচাপ বসে থাকা নীলাকে আমার এক সহকর্মী পাঠায়। নীরবে অশ্রুজল বিসর্জন এবং নিজের বেদনার কাব্য বলে চলেছেন নীলা। পরিবারের অনুপস্থিতিতেই বলতে চেয়েছেন নীলা, কখনো পুলিশ পরিবারের চেয়েও বেশি নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠে হয়তোবা! শুনছি আর বোঝাচ্ছি। দুইবার 'সুইসাইডাল এ্যাটেম্পট' নেয়া মেয়েটির জীবন প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকে। ডাকা হয় আকাশ ও তার পরিবারকে!
দুইদিনের ০৮ ঘণ্টার কাউন্সেলিং থেকে উপলব্ধি এই যে, আকাশ আর নীলা একে অপরকে অপছন্দ করেন না! তাও থমকে আছে জীবন অনিশ্চয়তার দোলাচলে। ভাইয়ের অনিশ্চিত মুখ, বেদনার ভারে জর্জরিত মায়ের প্রতিচ্ছবি সব মিলিয়ে এ যেন এক অচেনা পথের যাত্রা! আপনার, আমার কাছে মনে হতে পারে মেয়েটার ফিরে যাওয়া উচিত, কিন্তু মাথায় রাখতে হবে সকলের মানসিক অবস্থা এক নয়, ঠিক থাকে না সামজিক অবস্থানও। ঠিক এই জায়গায়টিতে এসেই আমরা থেমে যাই। তাই প্রখর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নীলা তাঁর এ্যাংগেজমেন্ট রিং ফিরিয়ে এনেও আবার আকাশকেই পেতে চায়। আকাশ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় দ্বিধান্বিত। সেই দ্বিধা কেটে যায় দুইদিনের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায়!
হ্যাঁ, আইনগত দিক থেকে এটি খুব বড় অর্জন নয়! কিন্তু যেখানে একজন মানুষের বেঁচে থাকা, দুজন মানুষের জীবন, দুটি পরিবারের সম্মান টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন চলে আসে সেখানে অর্জন নয় বরং কিছু করার তাগিদটাই মুখ্য হয়ে উঠে। আপনার চোখের সামনে পরিতৃপ্ত মায়ের হাসি, ভাইয়ের নিশ্চিত মুখ আর মেয়েটির হাসিখুশি চেহারা যখন বার বার ভেসে উঠবে, তখন আপনার মনে হবে আপনার এ জীবন স্বার্থক।
এরকম হাজারো ব্যক্তিগত, পারিবারিক সমস্যা নীরবে সমাধা হয়ে যায়। হ্যাঁ, মায়ের অপ্রিয় সন্তান অনেক পুলিশের কল্যাণেই তা হয়ে উঠে, তারা লিখেন না, তারা বলেন না তাই উঠে আসে না পত্রিকার পাতায়...! অনেকে মনে করেন এটা তো দায়িত্ব, কি দরকার জানানোর! তাই আলোচনার টেবিলে হয় না বলা...
দুটি হাতের অনামিকায় আবারও যখন ভালবাসার আংটি উঠে, একটি জীবন যখন রক্ষা পায়, দুটি মানুষ যখন এক হয়ে নীলাকাশ হয়ে যায়...তখন মনে হয় স্বার্থক এ জীবন, স্বার্থক এই বেঁচে থাকা...
(সত্য ঘটনায় ছদ্ম নামের ব্যবহার সম্পূর্ণ ইচ্ছানুসারে...)
লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন)
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি-প্রতিদিন/২৮ মে, ২০১৮/মাহবুব