মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ছাত্রী ধর্ষণে উত্তাল ক্যাম্পাস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে দিনভর স্লোগান-অবরোধ আলটিমেটাম, সন্ধ্যায় মশাল মিছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছাত্রী ধর্ষণে উত্তাল ক্যাম্পাস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ধর্ষণের প্রতিবাদ ও বিচার চেয়ে গতকাল ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, মশাল মিছিল, মানববন্ধনসহ কর্মসূচি পালন করা হয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাবি ক্যাম্পাস। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ প্ল্যাকার্ড হাতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন সকাল থেকেই। ঢাবির এ বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। মহাখালী, শাহবাগ, কুর্মিটোলাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা। দিনভর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, অবরোধ ও অনশন করে ধর্ষণের প্রতিবাদ ও ধর্ষকের দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দোষীকে বিচারের আওতায় আনার দাবি করেছেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, হাসপাতালসূত্র ও ভুক্তভোগীর সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রবিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক্ষণিকা’ পরিবহনের দোতলা বাসে (ঢাবি-টঙ্গী রুট) বাড়ি ফিরছিলেন ওই ছাত্রী। সন্ধ্যা ৭টার দিকে কুর্মিটোলায় বাস থেকে নেমে যাওয়ার পর তাঁকে পেছন থেকে মুখ চেপে ধরে নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকে শারীরিক আঘাত করা হয়। এক পর্যায়ে অচেতন অবস্থায় ধর্ষণ করা হয়। রাত ১০টার দিকে চেতনা ফেরার পর তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বান্ধবীর বাসায় যান। বান্ধবীকে ঘটনা জানালে তাঁর অন্য সহপাঠীদের সাহায্যে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। আর এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়তেই বিক্ষোভে ফেটে ওঠে ক্যাম্পাস।

দিনভর উত্তাল ক্যাম্পাস : ধর্ষণের প্রতিবাদে সকাল থেকেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আসতে থাকেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরে দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে  একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য, ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনসহ ছাত্রলীগ ও ডাকসুর অন্য নেতৃবৃন্দ।

মানববন্ধনে ধর্ষকের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার দাবি করে আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে উন্নীত করে মৃত্যুদন্ড করার আইন অতি শিগগির পাস করতে হবে। যারা আমাদের আশপাশে নারীদের নিয়ে বিভিন্ন কটূক্তি করে তাদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। এ ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার (আজ) সারা দেশে ছাত্রলীগের সব ইউনিটকে মানববন্ধন করার নির্দেশনাও দেন তিনি।

ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণের দ্রুত বিচারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে ডাকসুর এজিএস ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, এ আন্দোলন শুধু ঢাবির শিক্ষার্থী বলে নয়, দেশের যে কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরও যদি যৌন হয়রানি করা হয় তার প্রতিও যেন অবিচার না হয় সে লক্ষ্যেই এ আন্দোলন।

এদিকে, একই ঘটনার প্রতিবাদে বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলায় বিক্ষোভ করেছে ছাত্রদল। এতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলসহ সংগঠনটির বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী অংশ নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতনে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন। এ সময় ইকবাল হোসেন শ্যামল বলেন, আমরা প্রত্যাশা করব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে যেন এ ঘটনার বিচার হয়।

শাহবাগ অবরোধ : দুপুরে একটি মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এতে অংশ নেন কোটা আন্দোলনের প্ল্যাটফরম ‘সাধারণ ছাত্র পরিষদ’, বাম ছাত্রসংগঠন ও বিভিন্ন হল সংসদের নেতৃবৃন্দ। তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বর, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ও মধুর ক্যান্টিন হয়ে শাহবাগের দিকে যান। পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঘটনার প্রতিবাদ ও ধর্ষককে দ্রুত গ্রেফতারের আওতায় আনার দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। প্রায় আধঘণ্টার এ অবরোধে শাহবাগ মোড় দিয়ে যানবাহনের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় সেখানে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূসহ অন্যরা। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষককে গ্রেফতারের আলটিমেটামও দেন তারা। এ সময় আইওয়াশ না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীর ধর্ষণকারীকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূর। তিনি বলেন, ডাকসুতে হামলার ব্যাপারে সরকার যেমন আইওয়াশ করেছে, এ ঘটনায় যেন তা না করে। অবিলম্বে ধর্ষককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। না হলে ছাত্রজনতা কাউকেই ছেড়ে দেবে না। পরে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। আজ দুুপুরে আবারও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করবেন তারা।

এদিকে ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় আরও প্রতিবাদ জানিয়েছে মাইম অ্যাকশন সোসাইটি, ক্ষণিকা বাস পরিবার, ছাত্র পরিবহন পরিষদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। এ ছাড়া বিকালে রাজু ভাস্কর্যে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

ঢাবি শিক্ষক সমিতির প্রতিবাদ : ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ধিক্কার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে ঢাবি শিক্ষক সমিতি। গতকাল সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভুঁইয়া স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা অনতিবিলম্বে ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত নরপিশাচদের গ্রেফতার দাবি করছি এবং তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করব, তনুসহ অন্যান্য ঘটনার মতো ধর্ষণ ও নিপীড়নমূলক অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারের বাণী যেন আর নিভৃতে না কাঁদে- সেজন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

ধর্ষককে গ্রেফতারে পুলিশকে অনুরোধ ঢাবি উপাচার্যের : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে অনুরোধ জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, তাদের (জড়িতদের) ধরতে পুলিশ তৎপর আছে।

গতকাল হাসপাতালে ভর্তি ওই ছাত্রীকে দেখতে গিয়ে উপাচার্য এ কথা জানান। অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা খুবই মর্মাহত, চরম দুঃখজনক, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এটি। হাসপাতালে তাঁকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রীর মনোবল ভালো আছে। ঢাবি কর্তৃপক্ষ তাঁর অভিভাবক। প্রথমে তাঁকে মানসিকভাবে সামর্থ্য করে তুলতে হবে। এখন মূলত প্রধান কাজ হচ্ছে তাঁকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়া। পাশাপাশি নরপিশাচকে শনাক্ত করা, তাকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা।’ উপাচার্য আরও বলেন, থানা পুলিশ হাসপাতাল থেকেই পরিবারের কাছ থেকে মামলা নিয়েছে। তাঁর বাবা বাদী হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় সব ধরনের সহায়তা দেবে।

ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা : ঢাবি ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগীর বাবা বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করেছেন। একই সঙ্গে শাহবাগ থানায় ধর্ষণের ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

গতকাল দুপুরে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘ধর্ষণের ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা হয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল। সেটি ক্যান্টনমেন্ট থানায় পাঠানো হয়েছে।’

মেডিকেল বোর্ড গঠন : ধর্ষণের শিকার ওই ছাত্রীর চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই ছাত্রীর সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। তবে তিনি জানিয়েছেন, ভুক্তভোগী স্বাভাবিকভাবেই মানসিক বিষণœতায় ভুগছেন। তাঁকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর