বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মালয়েশিয়াগামী ট্রলার ডুবি

বঙ্গোপসাগরে ১৫ রোহিঙ্গার লাশ ও ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার

কক্সবাজার ও টেকনাফ প্রতিনিধি

মালয়েশিয়াগামী ট্রলার ডুবি

সাগর থেকে তোলার পর বাঁচানোর চেষ্টায় উদ্ধার কর্মীরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে মালয়েশিয়াগামী একটি যাত্রীবাহী ট্রলারডুবির ঘটনায় ১৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে আরও ৭২ জনকে। গতকাল সকাল ৭টার দিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ৭-৮ কিলোমিটার দূরে এ ঘটনা ঘটে। কক্সবাজারে আশ্রিত মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের ১৩৮ জন দালাল ধরে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টার পথে ট্রলারডুবির এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৫১ জন। তাদের উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে কোস্টগার্ড ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী। জানা গেছে, ট্রলারডুবিতে নিহতের মধ্যে ১২ জনই রোহিঙ্গা তরুণী, যারা বিয়ে করে সংসার পাতার স্বপ্নে দলবেঁধে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন বলে জানিয়েছেন উদ্ধার হওয়া বেশ কয়েকজন তরুণী। বাকি তিনটি লাশ শিশুদের। যে ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে তার মধ্যে ২৪ জন পুরুষ, ৪৬ জন নারী ও দুটি শিশু। উদ্ধারকৃতদের দুজন বাংলাদেশি দালাল বলে জানা গেছে।

কোস্টগার্ড-সূত্র জানান, গতকাল সকাল ৭টার দিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ৭-৮ কিলোমিটার দূরে এ ঘটনা ঘটে। অবৈধভাবে মালয়েশিয়াগামী ট্রলারের যাত্রীরা কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। সেন্ট মার্টিন কোস্টগার্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট নাইম উল হক বলেন, সোমবার রাতে টেকনাফ উপকূল দিয়ে দুটি ট্রলার মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়। গতকাল সকাল ৭টার দিকে সাগরের পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে একটি ট্রলার ডুবে যায়। উদ্ধার হওয়া কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, দালালদের মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে বের হয়ে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন। মর্মান্তিক ওই ঘটনায় দুই দালালকে আটক করা হয়েছে। বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের সহকারী পরিচালক (গোয়েন্দা) লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম হামিদুল ইসলাম জানান, ১৩৮ জনের মধ্যে এখনো ৫১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের উদ্ধারে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড। তিনি বলেন, উদ্ধার অভিযানকালে ওই বড় বোট থেকে দুই দালালকে আটক করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরপর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জীবিত উদ্ধার হওয়া টেকনাফের শামলাপুর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা তরুণী খাদিজা বেগম বলেন, ‘বাবা নেই, তাই যৌতুক দিয়ে বিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তায় জীবনটা এলোমেলো ছিল। শুনেছি, মালয়েশিয়ায় স্থানীয় ও প্রবাসীরা বিনা যৌতুকে তরুণীদের সম্মান দিয়ে বউ করে নেন। সংসারি হতেই ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় হয়নি।’ একই কথা বলেন মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ট্রলারে ওঠা রোকসানা বেগম, জাদিমুরার হোসনে আরা, লম্বাশিয়ার ইয়াসমিন। তারা বলেন, ‘ক্যাম্পে জীবনটা বিষিয়ে উঠেছে। স্বজাতিরাই অসহনীয় আচরণ করে। তাই ভালো ভবিষ্যতের সন্ধানে আমরা ঝুঁকি নিয়েছিলাম।’

জানা গেছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারকারী চক্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সোমবার রাতে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছিল রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলারটি। সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুর রব জানান, উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা তরুণীদের কয়েকজন বলেছেন মালয়েশিয়া যেতে জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের রাতের আঁধারে ট্রলারে তুলে দেয় দালালচক্র। বিয়ে করে নিরাপদ জীবনের আশায় মালয়েশিয়া যেতে ঝুঁকি নেন তারা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘ঘটনাটি মর্মান্তিক। কঠোর নজরদারি থাকায় গত বছর আদম পাচারকারী চক্র অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যেতে ট্রলার ভেড়াতে পারেনি। মহেশখালী, কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর, নাজিরার টেক, মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া, সোনাদিয়াসহ আরও কয়েকটি স্থান থেকে মালয়েশিয়ায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে জড়ো করা কয়েক শ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সোমবার চক্রটি রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলার সাগরে নামায়।’ তিনি বলেন, ‘উদ্ধার হওয়াদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দালালদের শনাক্তে কাজ করছে পুলিশ। এত মৃত্যুর পরও রোহিঙ্গারা প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা না মানলে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু রোধ করা কঠিন।’ গতকাল দুপুরে জেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কমিটির সভায় কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সাগরে ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজদের উদ্ধারে বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার, নৌবাহিনীর জাহাজ ও ডুবুরি এবং কোস্টগার্ডের প্রশিক্ষিত টিমের সদস্যরা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) রাকিবুল ইসলাম খান বলেন, ট্রলারডুবির ঘটনায় উদ্ধার ১৫ মৃতদেহের সুরতহাল তৈরি করে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানোা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পুলিশের একাধিক শক্তিশালী টিম উপকূলীয় এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে।

৯৯৯-এ ফোন দিয়েছিলেন আবদুল : স্থানীয় আবদুল বলেন, সোমবার রাতে ১৩৮ জন মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে টেকনাফের নোয়াখালীপাড়া থেকে ছোট ছোট ট্রলারে করে বড় একটি ট্রলারে নিয়ে যায় দালালরা। সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণের দিকে ছেঁড়া দ্বীপের কাছে পৌঁছালে ট্রলারটি পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে ট্রলারটির তলা ফেটে গিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। এ সময় দালাল ও মাঝি-মাল্লারা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে পালিয়ে যায়। আবদুল আরও বলেন, প্রথমে তিনি ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে বাঁচার আকুতি জানান। সেখান থেকে টেকনাফের কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার সোহেল রানার নম্বর দেওয়া হয়। পরে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে বিস্তারিত জানান আবদুল। তবে কোস্টগার্ডের অনুসন্ধানী দল খুঁজে পাওয়ার আগে ট্রলারটি ডুবে যায়। পরে কোস্টগার্ড সদস্যরা ভাসমান ১৫টি লাশ ও জীবিতদের উদ্ধার করেন। উদ্ধার টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো. জুবাইর বলেন, ‘টেকনাফের বাহারছড়া নোয়াখালীপাড়ার আবদুল আলীর ছেলে সাইফুল, সৈয়দ আলম ও নুরুল আলম আমাদেরকে ক্যা¤প থেকে নিয়ে আসেন। রাতে ওই এলাকা থেকে একটি ট্রলারে ১৩৮ জনকে তুলে দেন। সকালের দিকে সেন্ট মার্টিন থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি পাথরে ধাক্কা লেগে সঙ্গে সঙ্গে ট্রলারটি সাগরে ডুবে যায়।’ উদ্ধার হওয়া নারীদের মধ্যে উখিয়ার কুতুপালং-৪ ক্যাম্পের রোজিনা আক্তার জানান, তারা মিয়ানমারের রাখাইনে বাড়িঘর ও সংসার নিয়ে খুব ভালো ছিলেন। সেসব ঘরবাড়ি রেখে এখন ঠাঁই হয়েছে উখিয়ায় পাহাড়ের ঝুপড়ি ঘরে। এনজিওর দেওয়া ত্রাণে চলছে পরিবার। তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে বয়সটাও বাড়ছে। বিয়ে তো করতে হবে। অনেক চিন্তা করে পরিবারের সিদ্ধান্তে মালয়েশিয়া যাওয়ার চিন্তা করি। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত এক রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তার কাছে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বিয়ের স্বপ্ন পূরণ দূরে থাক, আল্লাহ প্রাণে রক্ষা করেছেন।’ এদিকে মানব পাচার রোধে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা জোর তৎপরতা ও প্রচার চালালেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, টেকনাফ সদরের লম্বরী, হাবির ছড়া, মিঠাপানির ছড়া, বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া, জুম্মাপাড়া, কচ্চপিয়া, বাঘঘোনা বাজার, মহেশখালী, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর, চৌফলদন্ডী, নাজিরার টেকসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে চিহ্নিত কতিপয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা, প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তির সহায়তায় এ অপতৎপরতা চলছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর