সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

দ্বিগুণ দামে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার পাঁয়তারা

সাখাওয়াত কাওসার

হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে লুটপাটের পাঁয়তারা চলছে। দ্বিগুণ দামে কেনা হচ্ছে সব যন্ত্রপাতি। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে একই যন্ত্রপাতির দাম দ্বিগুণের বিষয়টি খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতরে বহুল আলোচিত হচ্ছে। হাসপাতালের জন্য আগে সরঞ্জাম কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) মাধ্যমে কেনা হলেও এবার স্বাস্থ্য অধিদফতর নিজেরাই প্রায় ২০৪ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনছে। মোট ৪০৪ কোটি টাকার বাকি অর্ধেক কিনবে সিএমএসডি। অন্যদিকে মহা-লুটপাটের বিষয়টি বুঝতে পেরে তৎপর হয়ে উঠেছে একাধিক সংস্থা। শিগগিরই এসব তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা             বলছেন, সাধারণত হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট বা এইচএসএম সংক্রান্ত হাইটেক যন্ত্রপাতিগুলো আগে সিএমএসডির মাধ্যমে কেনা হতো। ২০২১-২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্য অধিদফতর বার্ষিক কেনাকাটার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরির পর তা দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪০৪ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) থেকে ইজিপির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ২৪টি প্যাকেজের আওতায় কেনাকাটা করার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে। তবে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করলেও কিছু যন্ত্রপাতির বৈশিষ্ট্য এমনভাবে চাওয়া হয়েছে, যাতে নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ সেটি সরবরাহ করতে না পারে। সিএমএসডির একটি সূত্র জানায়, সিএমএসডির ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির  বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। একাধিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিষয়টি মনোপলি ও নিয়মবহির্ভূত উল্লেখ করে চিঠিও দিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সরবরাহকারীদের যৌথ সিন্ডিকেট সিএমএসডিকে এই টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনেই দরপত্র আহ্বানের চাপ দিচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের বিভিন্ন নথিপত্রে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার যে প্রকিউরমেন্ট পলিকল্পনা  তৈরি করেছে, সেখানে একটি মেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের জন্য সাড়ে ৪ কোটি টাকা বাজেট ধরা হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর স্বাস্থ্য অধিদফতর সেই একই মেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কেনার জন্য ৮ কোটি টাকা বাজেট ধরেছে। এ ছাড়া গত বছরের অক্টোবর মাসেই কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ২৩৪টি আইসিইউ বেড কেনে প্রতিটি ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা করে। চলতি বছরও ৫০টি আইসিইউ বেড কেনা হবে, তবে প্রতিটি আইসিইউ বেডের জন্য বাজেট ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করে। এ ছাড়া গত বছরের তুলনায় প্রতিটি আইসিইউ ভেন্টিলেটরের ক্ষেত্রে প্রায় ৪ লাখ টাকা করে বাড়তি দাম ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে গত বছরের আগস্টে সিএমএসডি যেসব পেশেন্ট মনিটর কিনেছিল ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা করে, এই বছর একই পেশেন্ট মনিটর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ দাম ধরেছে ৬ লাখ টাকা করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গত ৯ মার্চ চারটি আলট্রাসনোগ্রাম, ফোরডি কালার ডপলার কেনার দরপত্র আহ্বান করেছে। প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনায় এই যন্ত্র কিনতে বাজেট ধরা হয়েছে প্রতিটি ৭০ লাখ টাকা করে। কিন্তু গত বছরই সিএমএসডি এই যন্ত্র কিনেছিল ৩৪ হাজার ডলার করে। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য ছিল মাত্র ২৯ লাখ টাকা। এসএস সায়েন্টিফিক করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই যন্ত্র সরবরাহ করেছিল। গত বছর আনিফকো হেলথকেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইকোকার্ডিওগ্রাফি ফোরডি ডপলার কিনেছিল ৫০ লাখ টাকা করে, এই বছর তা কেনার জন্য বাজেট করা হয়েছে ৭০ লাখ টাকা। একইভাবে গত বছর যে সিরিঞ্জ পাম্প কেনা হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা করে, এ বছর তা কেনার জন্য বাজেট ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গত বছর ইনফিউশন পাম্প কেনা হয়েছিল ৮৫ হাজার টাকা দরে, এ বছর বাজেট করা হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে। গত বছর যন্ত্রপাতি কেনাকাটার নথিপত্রে দেখা গেছে, জুলাই মাসে সিএমএসডি ধানমন্ডির ট্রেড হাউস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিঙ্গেল ব্লাড ব্যাগ প্রতিটি ১২০ টাকা, ডাবল ব্লাড ব্যাগ প্রতিটি ১৮০ টাকা ও ট্রিপল ব্লাড ব্যাগ প্রতিটি ২৭৭ টাকা করে কিনেছিল। এ বছর সিঙ্গেল ব্লাড ব্যাগ ২০০, ডাবল ব্লাড ব্যাগ ২৫০ ও ট্রিপল ব্লাড ব্যাগ ৩৫০ টাকা করে বাজেট করা হয়েছে। চলতি বছর মোট ৬ লাখ ৪২ হাজার ব্লাড ব্যাগ কেনার পরিকল্পনা করেছে সিএমএসডি।

নথিপত্র বলছে, গত বছরের জুলাইয়ে সিএমএসডি জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেস লিমিটেডের মাধ্যমে একটি ডায়ালাইসিস বেড কেনা হয় ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা করে। এ বছর ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ টাকা করে। গত বছর ল্যাপ্রোস্কোপি (গাইনি) কেনা হয় ৫০ লাখ টাকা করে। এ বছর ৬০ লাখ টাকা বাজেট ধরা হয়েছে। চলতি বছর মোট ২০টি ল্যাপ্রোস্কোপি মেশিন কেনা হবে।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার মেসার্স ডিয়ামেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সিএমএসডি চারটি প্লাজমা ফ্রিজার কিনেছিল, যার প্রতিটির দাম ছিল ১১ লাখ টাকা করে। এ বছর প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনায় প্রতিটির বাজেট ধরা হয়েছে ১৬ লাখ টাকা করে। একই প্রতিষ্ঠান সিএমএসডিকে রেফ্রিজেরেটেড সেন্ট্রিফিউজ মেশিন (৪ ব্লাড ব্যাগ) দিয়েছিল ২১ লাখ টাকায়, চলতি বছর তা কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা বাজেট করেছে সিএমএসডি। নথিপত্রে দেখা গেছে, সিএমএসডি এসএস সায়েন্টিফিক করপোরেশনের কাছ থেকে মডার্ন পোস্টমর্টেম ইকুইপমেন্ট কিনেছিল ২৪ লাখ টাকা করে। এবার প্রতিটির জন্য বাজেট ধরা হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা করে। এ ছাড়া গত বছর সিএমএসডি ৫০টি ওটি লাইট (ওটি লাইট, সেলিং মাউন্টেড, ডাবল ডোম, এলইডি) কেনে। যার প্রতিটি কেনা হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টাকা করে। এ বছর তা কেনার বাজেট ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা করে। চলতি বছর আরও ৩০টি ওটি টেবিল কেনা হবে। জানা গেছে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে অভিনব কৌশল নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিএমএসডির ক্রয় কমিটি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের লাইন ডিরেক্টর মাজহারুল ইসলাম তপন এই ক্রয় কমিটির প্রধান। এ ছাড়া তিনি টেকনিক্যাল কমিটিতেও আছেন। এমনকি সিএমএসডির ক্রয় কমিটিতেও রাখা হয়েছে তাকে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ হাসপাতাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কেনার জন্য যেসব টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন বা যন্ত্রের বিবরণ দিয়েছে, তার সঙ্গে ইকোডাস নামে ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রের বিবরণের সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিএমএসডি ব্লাড ইরেডিয়েটর কেনার জন্য একটি দরপত্র আহ্বান করে। ওই দরপত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠান রেড সোর্স এক্স-রে এর ‘আরএস ৩৪০০ মডেলের’ ব্লাড ইরেডিয়েটরের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন তুলে দেওয়া হয়েছে। যাতে রেড সোর্সের বাংলাদেশি এজেন্ট ছাড়া অন্য কেউ এই যন্ত্র সরবরাহ করতে না পারে সে জন্যই কৌশলে এটি করা হয়েছে। জানা গেছে, সারা দুনিয়ায় ইউএস এফডিএ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনেস্ট্রেশন) অনুমোদিত ব্লাড ইরেডিয়েটর তৈরি করে মাত্র তিনটি কোম্পানি। এসব বিষয়ে জানতে গত সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের লাইন ডিরেক্টর মাজহারুল হক তপনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সিএমএসডির পরিচালক মোখলেসুর রহমান সরকার বলেন, টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনের ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি এলে এ বিষয়ে সাধারণত পুনরায় বৈঠক করে পুনর্বিবেচনা করা হয়। আমরা প্রত্যেকটা বিষয় আমলে নিয়ে কাজ করছি। এক বছরের ব্যবধানে একই যন্ত্রের বিপরীতে দিগুণ বাজেট করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামা করার জন্যই এমনটা হতে পারে। সুনির্দিষ্ট করে বললে আমরা সেসব বিষয়ে অবশ্যই খতিয়ে দেখব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর