সোমবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
ঝুঁকিতে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ

মাটি কেটে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র

হাসান ইমন

মাটি কেটে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র

মাটি কেটে নেওয়ায় ঝুঁকিতে রেল সংযোগ সেতু -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কুন্ডা ইউনিয়নে কৃষকদের ফসলি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় একটি সংঘবদ্ধ চক্র। চক্রটি অবৈধভাবে ইউনিয়নের ৫-৬টি স্থান থেকে ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকা ডোবা ও নালায় পরিণত হয়েছে। পদ্মা রেল সংযোগ সেতুর খুব কাছাকাছি জায়গা থেকে মাটি কেটে নেওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি।

ফসলি জমি হারিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। কৃষিজমির মাটি কাটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন কান্দাপাড়ার সুজন, ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের বাবু মিঞা, পানগাঁওয়ের জাফর ইকবাল বাপ্পী, আইন্তা এলাকার রোমান ও আরাকুলে সোহাগ মিঞা। এসব নেতার প্রত্যেকে ৪-৫ জন করে শক্তিশালী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। এই মাটিকাটা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অসহায় জমির মালিকরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ করেও কোনো ফল পায়নি তারা। উল্টো বিভিন্ন হুমকি ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে তাদের। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাটি কাটার সিন্ডিকেট চক্রটি পুরো ইউনিয়নে অবৈধভাবে মাটি কাটছে। স্থানীয় কৃষক ও আশপাশের ইউনিয়নসহ অন্য এলাকা থেকে আসা মানুষের কিনে রাখা জমিগুলো থেকে মাটি কেটে বিক্রি করছে। এতে এসব জমি ডোবা, নালা ও পুকুরে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো জমি ৫০-৬০ ফুটও খনন করেছে। কোথাও কোথাও বাড়ির পাশের জায়গা থেকে এমনভাবে মাটি উত্তোলন করেছে, এখন বাড়িগুলো ধসে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে জমি কিনেছে, তাদের জমির মাটিগুলো রাত-দিন বিভিন্ন সময় কেটে নিয়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র। ক্ষতিগ্রস্তরা বাধা দিলেও কোনো ফল পাচ্ছেন না। এসব সিন্ডিকেটের মধ্যে কান্দাপাড়া গ্রামের কাওটাইল মৌজার মাটি কাটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুজন। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে সাদ্দাম, জরিফ উদ্দিন, মামুন ও পানগাঁওয়ের কামাল মেম্বার। এ ছাড়া ব্রাহ্মণগাঁও এলাকার ব্রাহ্মণগাঁও মৌজার মাটি কাটার নেতৃত্বে রয়েছে কাজিরগাঁও গ্রামের বাবু মিঞা। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে সহিদ ও পারভেজ। পানগাঁও গ্রামের পূর্ব বাঘৈর মৌজার ঋষি বাড়ি এলাকায় মাটি কাটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাফর ইকবাল বাপ্পী। তার সহযোগী দক্ষিণ পানগাঁওয়ের জুয়েল আহম্মেদ ডন, কাউসার ও পলাশ। কাজিরগাঁও গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেন, আরাফাত রহমান টিপু, বাবু, দক্ষিণ বাঘৈর গ্রামের আফজাল ও কাজিরগাঁও গ্রামের মাসুম। এই চক্রটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ২-৩টি সাইটে মাটি কেটে বিক্রি করে। আইন্তা গ্রামের বীর বাঘৈর মৌজায় মাটি কাটার নেতৃত্বে রয়েছেন রোমান। তার নেতৃত্বে আরও আছে অন্তর, হিমেল ও আইন্তা গ্রামের ভেলু মিঞা। আর আড়াকুল গ্রামে সোহাগের নেতৃত্বে রয়েছেন একই গ্রামের পারভেজ, টিক্কা মিঞা ও জয়নাল। এর বাইরে কাজির গ্রামের রাহাত ও কান্দাপাড়া গ্রামের কাশেম ব্যাপারী এই সিন্ডিকেটে রয়েছে। এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে স্থানীয় কৃষক ও জমির মালিকরা অসহায়। তাদের জায়গার মাটি কেটে ডোবা ও নালায় পরিণত করেছে। এসব মাটি যাচ্ছে ইউনিয়নের বিভিন্ন ইটভাটা ও ফসলি জমিতে বিভিন্ন স্থাপনার কাজে। এই নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হলে কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকে। কিছুদিন পরে আবার তারা পুরোদমে মাটি কাটা শুরু করে। পুরো এলাকার অধিকাংশ জমির মাটি কেটে ফেলায় পদ্মা রেলওয়ে সেতুসহ আশপাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে রয়েছে। অবৈধ মাটি কাটার এই সিন্ডিকেটটি প্রশাসনকে হাতের মুঠোয় রেখে এসব কর্মকান্ড করছে বলে স্থানীয়রা জানায়।

গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় পানগাঁও গ্রামের পূর্ব বাঘৈর মৌজায় সরেজমিনে দেখা গেছে, মোয়াজ্জেম ও পলাশের নেতৃত্বে একটি ভেকু দিয়ে ৭-৮টি ট্রাকে মাটি কেটে ভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। ওই সময় গণমাধ্যমের উপস্থিতি টের পেয়ে মোয়াজ্জেম, পলাশসহ ট্রাকচালক, হেলপার ও ভেকুচালক সবাই দৌড়ে পালিয়ে যায়। তবে মনির নামে একজন মাটি কাটার স্থানে শুয়ে ছিল। পরবর্তীতে তার কাছে জানা যায়, তিনি মাটি কেনার জন্য এখানে এসেছেন। ৩ শতাংশ জমি ভরাট করবেন বলে তাদের সঙ্গে দরদাম ঠিক করতে এসেছেন। মাটি বিক্রি করে ওরা কারা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোয়াজ্জেম, পলাশ, ডনসহ আরও কয়েকজন এখান থেকে মাটি কেটে বিক্রি করে। এই কাজ তারা অনেকদিন থেকে করে।

এই মাটি কাটার স্থান থেকে ১০০ ফুট দূরত্বে কিছুদিন আগে ৩০ শতাংশ জায়গার মাটি কেটেছে এই সিন্ডিকেট। এই জায়গার পাশে ১৮ শতাংশ জায়গার ওপর বাড়ি তৈরি করেছে হাওয়া বেগম। এই জায়গাটুকু তার পৈতৃক সম্পত্তি। গণমাধ্যমের উপস্থিতি দেখে তিনি সাংবাদিকদের সামনে অভিযোগ করতে আসেন। হাওয়া বেগম বলেন, এই এলাকায় পলাশ, ডন, মোয়াজ্জেম, আরাফাত রহমান টিপু, বাবু, অনেক দিন থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আমারও কিছু জমি এই চক্রটি দখল করেছে। এখন আমার বাড়ির পাশে অন্য এক লোকের জমির মাটি কেটে নিয়ে গেছে। এই জায়গাটি ২০ ফুটের মতো গর্ত করেছে। এই মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় এখন আমার বাড়ি হুমকির মুখে পড়েছে। আস্তে আস্তে সীমানা ভেঙে পড়ছে। কিছুদিন পর আমার বাড়িও ভেঙে যাবে।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে অভিযোগ করে লাভ হয়নি। উল্টো তাকে মেরে ফেলার হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর আমাকে ভিটেমাটি ছাড়ারও হুমকি দিয়েছে সিন্ডিকেট চক্রটি। এই চক্রটি এমন প্রভাবশালী তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে এলাকা ছাড়া করে তারা। তাদের পেছনে প্রভাবশালী হাত রয়েছে। ‘ওরা আমাগো এই এলাকায় থাকতে দিবো না’ বলে হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

একই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা তসলিম। তিনি বলেন, আমার জন্ম এই এলাকাতেই। জমি কেনাবেচার ব্যবসা করি। বীর বাঘৈর ও পূর্ব বাঘৈর এলাকায় স্থানীয় একটি চক্র স্থানীয় কৃষকদের জমি এবং দূর-দূরান্ত থেকে এসে অনেকে বাড়ি নির্মাণের উদ্দেশে কিনে রাখা জায়গাগুলোর মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা কিছু বলতে পারি না। কিছু বললে উল্টো হুমকি দিয়ে বলে তোর মাটি কাটছি নাকি। তুই চুপ থাক। নইলে খবর আছে।

ব্রাহ্মণগাঁও এলাকায় দেখা গেছে, অধিকাংশ জমির মাটি কেটে নিয়ে গেছে। প্রায় জমি ডোবা, নালা ও পুকুরে পরিণত হয়েছে। পদ্মা রেলওয়ে সেতুর বিভিন্ন প্রান্তে বড় বড় জায়গার মাটিও কেটে নিয়েছে। কোথাও কোথাও সেতুর ৫০-১০০ ফুট দূরত্বে বিশাল এলাকাজুড়ে ৫০-৬০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নিয়েছে। এতে রেলসেতুর পিলার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর বাইরে এই এলাকার জমির অধিকাংশ মালিক স্থানীয়রা। এই এলাকার জমির মাটি কেটে নিলেও মালিকরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না বলে স্থানীয়রা জানান। প্রতিবাদ করলে নানা হুমকিসহ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়। এমনই এক ভুক্তভোগী পারভীন আক্তার। তার জায়গার মাটি কেটে নিয়ে গেছে বাবু, পারভেজ ও সহিদ গংরা। প্রতিবাদ করেও মাটি আটকাতে পারেননি। পারভীন অভিযোগ করে বলেন, শুধু আমি নয়, এই এলাকার অধিকাংশ মানুষই সিন্ডিকেটে ধরাশায়ী। তারা কাউকে ছাড়েনি। তাদের কেউ কিছু করতে পারে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, এই এলাকার মাটি বেশির ভাগ যায় ব্রিক ফিল্ডে। সবচেয়ে বেশি যায় মোখলেছের ব্রিক ফিল্ডে। তিনি এই এলাকার চক্রের সঙ্গে হাত করে মাটি নিয়ে যায়।

আড়াকুল এলাকায় দেখা গেছে, আড়াকুল মৌজায় অধিকাংশ জমির মাটি কেটে নিয়ে গেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই জায়গাটি ২৫-৩০ ফুট খনন করে মাটি নিয়ে গেছে। এই জায়গাটির পাশে ভেকু রেখে দিয়েছে তারা। গণমাধ্যমের উপস্থিতি টের পেয়ে আগেই স্থান ত্যাগ করেছে। স্থানীয়রা জানায়, এই এলাকায় অবৈধভাবে মাটি কাটার নেতৃত্ব দিচ্ছে সোহাগ। তার নেতৃত্বে রয়েছে পারভেজ, টিক্কা মিঞা ও জয়নাল। এদের নেতৃত্বে কয়েক বছর ধরে এই এলাকার মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে এই চক্রটি। নর্দা এলাকার বীর বাঘৈর মৌজায় দেখা গেছে, দুটি স্থানে মাটি কাটার ভেকু মেশিন রাখা আছে। গণমাধ্যমের উপস্থিতি টের পেয়ে আগেই তারা পালিয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানায়। এলাকায় মাটি কারা কাটছে জানতে চাইলে স্থানীয়রা জানায়- রোমান, অন্তর, হিমেল, নাঈমসহ কয়েকজন মাটি কাটার নেতৃত্ব দেয়।

এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে মাটি কাটার কোনো নিয়ম নেই। তবে আমি শুনেছি যে, সেখানে কিছু ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। জমির মাটি লুটের ঘটনা ঘটে থাকলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার ফলে ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না আমরা সেটা ক্ষতিয়ে দেখব। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, অবৈধভাবে মাটি কেটে নেওয়া অবশ্যই বেআইনি এবং যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। যারা এই কাজটি করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোনো জমি অবাধ রাখা যাবে না। আর সেখানে একটি চক্র জমির ৫০ ফুট মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে তো কোনোভাবে ফসল ফলানো সম্ভব না। আমরা আইনি ব্যবস্থায় যাব। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহজামান বলেন, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বিভিন্ন জায়গায় মাটি কাটার দৃশ্য দেখা যায়। কারা বা কোন গোষ্ঠী মাটি কাটে এটা আমরা বলতে পারব না। ইতিপূর্বে আমরা অবৈধভাবে মাটি কাটার অভিযোগ পেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন আমরা এ বিষয়ে খতিয়ে দেখব।

সর্বশেষ খবর