বুধবার, ২২ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

তিন রোগের ব্যয়ে যত উৎকণ্ঠা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

তিন রোগের ব্যয়ে যত উৎকণ্ঠা

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী পদে কর্মরত তাইফুল ইসলাম (৩৫)। তার স্ত্রীর দুটি কিডনি দুই বছর ধরে বিকল। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে দুই দিন সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় ১ হাজার ১২০ টাকা। মাসে কিডনি ডায়ালাইসিসে খরচ হয় ৬ হাজার ৭২০ টাকা। এর সঙ্গে ওষুধ, চিকিৎসক, যাতায়াত মিলিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয় চিকিৎসার পেছনে। স্বল্প    বেতনে চালাতে না পেরে দেনায় জড়িয়ে গেছি। বেসরকারি হাসপাতালে এ খরচ দ্বিগুণেরও বেশি। কতদিন চালাতে পারব জানি না।’

দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুরারোগ্য ব্যাধি কিডনি, ক্যান্সার ও হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী। এই তিন রাজরোগের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে উৎকণ্ঠা বাড়ছে রোগী ও স্বজনদের। প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে ভুগছেন। প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ক্যান্সারে এবং ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে হৃদরোগে।

খাদ্যাভ্যাস, ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল, অতিরিক্ত ওষুধ সেবনকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। ডায়াবেটিস ও হাইপার টেনশনে থাকা মানুষের কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কিডনি, ক্যান্সার, হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় খরচ বহনে হিমশিম খান রোগীর স্বজনরা। ওষুধের দাম বাড়ায় চিকিৎসা ব্যয় আরও বেড়েছে। নানা ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত বাড়ছে। কিন্তু দেশে আক্রান্তের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় কাজে আসছে না কোনো উদ্যোগ। চিকিৎসা কেন্দ্র, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকটে ক্যান্সার চিকিৎসা। সংকট কাটাতে দেশের আটটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, সাধারণত ফুসফুস, স্তন, জরায়ুমুখ, মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী বেশি। এ ছাড়া খাদ্যনালি, পাকস্থলী, লিভার, বাকযন্ত্র, পায়ুপথ, ডিম্বাশয়, বৃহদান্ত, সারভাইকাল, লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় মানুষ।

রংপুরের কৃষক সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত। এই কৃষক ইতোমধ্যে কৃষিজমি ও গবাদিপশু বিক্রি করেছেন। তিন বছরে তার স্ত্রীর ক্যান্সারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ও ওষুধের খরচ চালাতে এখন ঋণগ্রস্ত সিরাজুল। ঢাকায় থাকার মতো বাসা ভাড়া নেওয়ার সামর্থ্য নেই এই দম্পতির। সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে টাকা ধার করতে পারলে আমার স্ত্রী কেমো পায়। ধার করতে না পারলে নির্দিষ্ট তারিখে কেমো দেওয়াতে পারি না।’ এ রোগের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত ৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি।

‘ডিজিজ-স্পেসিফিক ডিসট্রেস হেলথকেয়ার ফাইন্যান্সিং অ্যান্ড ক্যাটাস্ট্রোফিক আউট-অব-পকেট এক্সপেন্ডিচার ফর হসপিটালাইজেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ২৬ শতাংশ পরিবার গত কয়েক বছরে হাসপাতালে ভর্তির জন্য বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় (সিএইচই) করেছে। এ ধরনের ব্যয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ক্যান্সার (৫০ শতাংশ), এর পরেই রয়েছে যকৃতের রোগ (৪৯.২ শতাংশ) এবং পক্ষাঘাত (৪৩.৬ শতাংশ)। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় ধরনভেদে অপারেশন, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি দিয়ে শুধু চিকিৎসা খরচ প্রায় ২-৩ লাখ টাকা পড়ে। এর সঙ্গে যাতায়াত, ওষুধপত্রসহ আনুষঙ্গিক আরও খরচ হয়। বেসরকারি মাঝারি মানের হাসপাতালে এ খরচ প্রায় ১০-১২ লাখ টাকা পড়ে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার আওতায় আসতে পারেন মাত্র ৫ শতাংশ ক্যান্সার রোগী। বাকি ৯৫ শতাংশ রোগীর মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তারা বেসরকারি হাসপাতালে যান। দেশে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের চিকিৎসার অবস্থা করুণ।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে স্বাস্থ্যবীমা জরুরি। কিন্তু এর তেমন অগ্রগতি নেই। সরকারের একার পক্ষে এত রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে খরচ কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের প্রণোদনা, সুবিধা কিংবা আইন করে খরচ কমাতে বাধ্য করতে হবে। দেশের ধনী ব্যক্তিদের দাতব্য হাসপাতাল করতে উৎসাহিত করতে হবে।’

ক্যান্সারের মতোই আরেক ভয়াবহ ঘাতক কিডনি রোগ। রোগী ও স্বজনদের সর্বস্বান্ত করে এ রোগের চিকিৎসা ব্যয়। কিডনি অকেজো হওয়ার পর ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকতে রোগীদের ১২-২২ শতাংশের সম্পদ বিক্রি করতে হচ্ছে। দেশের কিডনি রোগীদের এক শতাংশেরও কম কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা রয়েছে। তবে কিডনি রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় নিরূপণ করতে পারলে চিকিৎসায় সুস্থ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় নেফ্রলজিস্ট নেই। চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায় অনেকেই মাঝপথে বন্ধ করে দিচ্ছেন চিকিৎসা। সচেতনতা, চিকিৎসক ও চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা এবং মৃত ব্যক্তির কিডনি সংগ্রহে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সম্প্রতি সারাহ ইসলাম তার দুটি কিডনি ও কর্ণিয়া দান করে চারজন মানুষকে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান অন্যদের অনুপ্রাণিত করলে আরও অনেকের জীবন বাঁচানো ও দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শেখ মইনুল খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস এবং ট্রান্সপ্লান্ট হলে চিকিৎসা নিরবচ্ছিন্ন চালিয়ে যেতে হয়। কিডনি ডায়ালাইসিস করতে রোগীকে নিয়ে আসতে যেতে আরেকজনকে আসতে হয়। রোগী নিজেও কর্মক্ষম থাকে না, আবার পরিবারের আরেকজন কর্মক্ষম ব্যক্তিকে তার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়। আমাদের কাছে অনেক রোগী শুরুতে কেবিন নিয়ে চিকিৎসা করে কিন্তু একটা সময় তারা খরচ চালাতে না পেরে বিনামূল্যের শয্যা চায়। আমরা ভর্তুকি দিয়ে হলেও রোগী না পারলে তাকে ডায়ালাইসিস দিয়ে থাকি। কিন্তু এটাকে তো সারা দেশের চিত্র বলা সম্ভব নয়।’

বর্তমান বিশ্বে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। কিছু দিন আগ পর্যন্তও দেশে বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি, তবে গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগের প্রবণতা বেড়েছে। দেশে বর্তমানে শতকরা ৫৩ ভাগ মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ। উচ্চরক্তচাপ ও গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের কারণে বাড়ছে হৃদরোগ ঝুঁকি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে হৃদরোগী আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। আমরা গবেষণায় দেখেছি সব বয়সী মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিছুদিন আগে আমরা এক রোগীর বাইপাস সার্জারি করেছি তার বয়স ছিল ১১ বছর। হার্টের এমন অবস্থা ছিল যে, রিং পরানোর মতো জায়গা ছিল না। তরুণদের মধ্যে হৃদরোগ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়েছে। ডায়াবেটিস, ধূমপান, চর্বিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড গ্রহণ, কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়া, স্থুলতা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া পারিবারিক রোগের ইতিহাস থাকলে বংশগত কারণে অনেকে আক্রান্ত হয়। তিনি আরও বলেন, ‘সচেতনতা বাড়ায় মানুষ এখন শারীরিক সমস্যা বোধ করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারে। এতে রোগী শনাক্ত বেড়েছে। সচেতন হলে হৃদরোগ ঝুঁকি অনেকটা কমানো যাবে।’

চিকিৎসকরা জানান, হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে- বুকের একপাশে কিংবা চারপাশে ব্যথা অনুভব হওয়া, বুক ভারী লাগা, শরীরের অন্য অংশ যেমন- বাম হাতে, পিঠে, চোয়ালে এ ব্যথা হতে পারে। ব্যথার সঙ্গে ঘাম হওয়া, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, বমি বমি ভাব হওয়া, বুক ধড়ফড় করা বা বিনা কারণে অস্থির লাগা, মাথা ঝিমঝিম করা ইত্যাদি উপসর্গ থাকতে পারে। এ ধরনের উপসর্গ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

 

সর্বশেষ খবর