বাংলাদেশে প্রায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ফিরে মার্কিন প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল সংলাপ আয়োজনের সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে অর্থবহ সংলাপসহ পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে মার্কিন ওই প্রতিনিধি দল। গতকাল ওয়াশিংটন থেকে প্রচারিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দলের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে এবং আসন্ন নির্বাচন হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি লিটমাস টেস্ট’।
সংলাপ ছাড়া মার্কিন প্রতিনিধি দলের অন্য চার সুপারিশ হলো- রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা, বাক-স্বাধীনতার সুরক্ষা ও ভিন্নমতকে সম্মান করা হয় এমন পরিবেশ তৈরি করা, স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনাসহ এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে সব দল একটি অর্থবহ নির্বাচনি প্রতিযোগিতায় শামিল হতে পারে এবং নাগরিকদের মধ্যে সক্রিয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা। বলা হয়েছে, এসব সুপারিশ একটি রোডম্যাপ তৈরি করবে, যা গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
জানা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর বিষয়টি মূল্যায়ন করতে ৭ অক্টোবর ঢাকায় এসেছিল মার্কিন প্রতিনিধি দলটি। ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রিসভার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্য, নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, কূটনীতিকসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে বৈঠক করেন।
প্রতিনিধি দলের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঐতিহ্য দেশটির উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ২০৪১ সালের রূপকল্প অর্জনের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে। তারপরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। অগ্রগতির কিছু ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ নির্বাচনি অখন্ডতার সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে আপসহীন রাজনৈতিক মানসিকতা, আক্রমণাত্মক বক্তৃতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, অনিশ্চয়তা, ভয়ের একটি বিস্তৃত পরিবেশ, নাগরিক সমাজ-মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া, নাগরিক-রাজনৈতিক নেতা-অন্যান্য অংশীজনের মধ্যে আস্থার ঘাটতি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারী, যুবক ও অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীও উল্লেখযোগ্য বাধার সম্মুখীন হয়। উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা টেকসই উন্নয়নের দিকে বাংলাদেশের ইতিবাচক অগ্রযাত্রাকে বিঘিœত করতে পারে।
প্রতিনিধি দলের বিবৃতির সুপারিশ অংশে বলা হয়, এ সুপারিশগুলো বাংলাদেশের অংশীজনরা নির্বাচনের আগে-পরে অর্থাৎ সমগ্র নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করবে। বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অহিংস নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের রূপরেখা হবে। সুপারিশ-১, সহনশীল বক্তৃতা ও নির্বাচনি মুখ্য ইস্যুতে খোলামেলা-অর্থবহ সংলাপে বসা। এর আওতায় রাজনৈতিক দলগুলো জনসম্মুখে মধ্যমপন্থা বজায় রাখবে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয়গুলোর বৈধতাকে স্বীকার করবে। বিদ্যমান আচরণবিধিকে শক্তিশালী ও প্রসারিত করার কাজও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সৎ ও ন্যায়পরায়ণ পন্থায় আপস করবে, যাতে তারা বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধান করে প্রকৃত, টেকসই ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। সুপারিশ-২, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা ও নাগরিকদের জন্য খোলামেলা পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে ভিন্নমতকে সম্মান করা হয়। এর আওতায় কোনো প্রকার ভয়ভীতি ছাড়াই সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে সব রাজনৈতিক দল, সরকারি মহল এবং বিভিন্ন ইস্যুতে স্বাধীনভাবে আলোচনা-সমালোচনা করার সুযোগ দেওয়া হবে। নাগরিক সংগঠনগুলো যারা বিশেষভাবে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে তাদের কাজে কোনো বাধা দেওয়া যাবে না। নতুন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহার করা যাবে না। ভিন্নমতাদর্শকে আক্রমণ করা যাবে না। সরকারকে নাগরিক এবং অন্যান্য অংশীজনের থেকে মতামত গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনি নীতি এমন হতে হবে, যা নাগরিক পর্যবেক্ষকদের নির্বাচনের সব পর্যায়ে প্রবেশের সুযোগ দেবে। সুপারিশ-৩, সহিংসতার বিরুদ্ধে অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এর আওতায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা যেন সহিংসতার শিকার না হয়। তারা আইনি প্রক্রিয়া ও অহিংস রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার সময় যেন সমনিরাপত্তা পায়। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে অহিংসতার নীতি মেনে চলতে হবে। তাদের মধ্য থেকে কোনো সদস্য বা সমর্থক সহিংসতা করলে তাদের দন্ড প্রদান করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর বহুদলীয় রাজনৈতিক অহিংসতার নিয়মনীতি মেনে চলা উচিত। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধেও সচেতন থাকতে হবে দলগুলোকে। সুপারিশ-৪, স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনাকে শক্তিশালী করাসহ সব দলের অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করা। এর আওতায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের জনবল ও অর্থায়ন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। নির্বাচন এমন উপায়ে পরিচালনা করতে হবে, যাতে তা বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হয়। গণতান্ত্রিক কার্যকলাপ পরিচালনা করা সব দলের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মী, সুশীল সমাজের নেতা এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে চলা মামলার দ্রুত এবং বিশ্বাসযোগ্য আইনি রিভিউ নিশ্চিত করতে হবে। সুপারিশ-৫, নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সক্রিয় নির্বাচনী অংশগ্রহণের সংস্কৃতি উৎসাহিত করা। এর আওতায় সব অংশীজনকে অহিংস, মধ্যমপন্থি ও সম্মতিমূলক রাজনীতি নিশ্চিত করতে হবে। সংরক্ষিত আসনের বাইরেও রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন মুখ বিশেষ করে নারী, তরুণ, প্রতিবন্ধী ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুযোগ দিতে হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, এ প্রতিনিধি দল স্বীকার করে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও আইনগত বাধ্যবাধকতা আসলে বাংলাদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশসহ নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সফর করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।