ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে বিদেশে পালিয়ে গেলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে নাগরিকদের ফোনে অনৈতিকভাবে আড়িপাতার কাজে অন্যতম প্রধান সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি।
ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) কারিগরি উন্নয়নের নামে সাধারণ নাগরিকদের ফোনে আড়ি পেতে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে টাইগার আইটি। গত ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক বিদায় নিলেও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা টাইগার আইটির কর্ণধার জিয়াউর রহমান এখনো রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত অবৈধভাবে ফাঁসে এনটিএমসির কর্মকর্তারা আইনের আওতায় এলেও জিয়াউর রহমানকে ধরা হয়নি অজানা কারণে।
অনুসন্ধান বলছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং শেখ রেহানার দেবর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় এনটিএমসির বিতর্কিত উদ্যোগের টেকনিক্যাল সাপোর্টের কাজ পায় টাইগার আইটি।জানা গেছে, তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আড়িপাতার অবৈধ যন্ত্র আমদানিতে গত এক দশক ধরে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি টাইগার আইটি। দেশের অভ্যন্তরেও কোনো প্রকার যাচাইবাছাই ছাড়াই আইটি সম্পর্কিত হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু তাই নয়, ওই উপদেষ্টার প্রভাব খাটিয়ে প্রকল্পকে অতিমূল্যায়িত করেও বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় করিয়েছে টাইগার আইটি। জানা গেছে, তুসাকা গ্রুপ নামে একটি গুচ্ছ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তারিক আহমেদ সিদ্দিকের স্ত্রী শাহনাজ সিদ্দিক। আড়ালে থেকেই পরিচালনা করেন তুসাকা গ্রুপের অধীন নভোটেল, নভো এয়ার, নভোকম, পেন্টা গ্লোবাল নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই তুসাকা গ্রুপের আশীর্বাদেই টাইগার আইটি, আইবিসিএস-প্রাইমেক্স এবং কম্পিউটার সার্ভিস লিমিটেড (সিএসএল) যুক্ত হয় এনটিএমসির আড়িপাতা প্রকল্পের কারিগরি উন্নয়নে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইসিটি খাতে বিগত সরকারের সময়ে লুটপাপ চালিয়েছে টাইগার আইটি। এমনকি নাগরিকদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্যউপাত্ত সংগ্রহে অবৈধভাবে আড়িপাতার যন্ত্রপাতি আমদানি, স্থাপন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে টাইগার আইটি।
অথচ অনিয়ম-জালিয়াতির কারণে নির্বাচন কমিশনের স্মার্ট কার্ড উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে কালো তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এনটিএমসির মতো স্পর্শকাতর প্রকল্পে ব্যক্তিগত স্বার্থে যুক্ত করা হয় টাইগার আইটিকে। শুধু তারেক আহমেদ সিদ্দিকের প্রভাব খাটিয়েই কালো তালিকাভুক্ত এই কোম্পানি সরকারি প্রকল্পের হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা এপনিকের নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবির বলেন, কোনো সভ্য দেশে ফোনে আড়িপাতাকে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ মানবাধিকারকে আইনের মাধ্যমে লঙ্ঘন করা হয়েছে।
ভিক্যাল মাউন্টেড ডাটা ইন্টারসেপ্টর, ভিক্যাল মাউন্টেড মোবাইল ইন্টারসেপ্টরের মতো নজরদারি যন্ত্র ব্যবহার করে এনটিএমসি। সংস্থাটির জন্য ইসরায়েলি সাইবার গোয়েন্দা কোম্পানি এনএসও গ্রুপের কাছ থেকে পেগাসাস স্পাইওয়?্যারও ক্রয় করা হয়েছিল। সফটওয়্যারটির মাধ্যমে মোবাইল ফোন হ্যাক করা যায়। অ্যাপটি একবার কারও মোবাইল ফোনে ইনস্টল করা হলে তা দিয়ে নজরদারি প্রতিষ্ঠান সেই ফোনের মেসেজ, ফটো বা ই-মেইল হস্তগত করতে পারে। ফোনে কথাবার্তা রেকর্ডের পাশাপাশি গোপনে মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা চালু করতে পারে।
প্রযুক্তি সেবাদাতা বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ডাটা বা সার্ভারের দায়িত্ব এমন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া উচিত যাদের প্রতিষ্ঠানে ভালো লেভেলের সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট এবং হ্যাকার থাকবে। শুধু দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা আগে সরকারি কাজ পেয়েছে বলে সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে, সেটা অবশ্য ঝুঁকিপূর্ণ। টাইগার আইটির ক্ষেত্রে তাদের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত নজর দেওয়া উচিত ছিল। তাদের এনআইডি, জন্ম নিবন্ধন ও বিআরটিএ প্রকল্পের তথ্য ফাঁসের ঘটনা সামনে আসার পরেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। তিনি আরও বলেন, বিশেষত যখন সেটা নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত আধুনিক নিরাপত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করা এবং সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করা, যেন এ ধরনের ঘটনা পুনরায় না ঘটে।
জানা গেছে, নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষিত থাকে এনটিএমসির কাছে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রয়োজনে এসব তথ্য ব্যবহার করা হতো। এনটিএমসি পরিচালিত হতো সরকারের বিশেষ একটি সংস্থার অধীনে। মোবাইল ফোনের ভয়েস ও এসএমএস, ল্যান্ডফোন ভয়েস এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আড়ি পাততে পারে এনটিএমসি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ফেসবুক, টুইটার (বর্তমান এক্স), টেলিগ্রাম, ভাইবার, ইমো, স্কাইপি অ্যাপেও আড়ি পাততে পারে এনটিএমসি। অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ওয়েবসাইট ব্লগ, ই-মেইল এবং কন্টেন্ট ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে শতভাগ আড়িপাতার সক্ষমতা রয়েছে সংস্থাটির।সূত্র আরও জানায়, সাধারণ মানুষের ফোনের নিয়ন্ত্রণ নিতে গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক এবং টেলিটকের ব্যাকএন্ডে ফায়ারওয়াল স্থাপন করা হয়েছে এনটিএমসির মাধ্যমে। ফলে চার অপারেটরের ডেটা এবং ভয়েস সেবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এনটিএমসি। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় অনেক বিরোধী নেতা-কর্মীর ফোন ট্র্যাক করে গ্রেপ্তার করতে সহায়তা করেছে এনটিএমসি। এ কাজে সহায়তার জন্য অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে টাইগার আইটি।
জানা গেছে, সরকারি প্রকল্পের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিগত সময়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে টাইগার আইটির কর্ণধার জিয়াউর রহমান। তিনি মার্কিন পাসপোর্ট ব্যবহার করে বর্তমান দুবাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এনটিএমসির বিতর্কিত সেবা প্রসঙ্গে, সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাগরিকদের ফোনে গোপনে আড়িপাতা অবৈধ। এখানে নৈতিকতার প্রশ্নও আছে। দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য যদি মনিটরিং হয়, সেটা ভালো। তবে আমরা জেনেছি এনটিএমসির বিতর্কিত ভূমিকা। এখানে টাইগার আইটির মতো একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার ওপরে নিয়ে যাওয়ায় তথ্য ফাঁসে ঝুঁকি থেকেই যায়। তারা যে এই তথ্য দেশের বাইরে কারও কাছে অর্থের বিনিময়ে সরবরাহ করেনি সে রকম নিশ্চয়তাও নেই। ফলে এ ধরনের কাজের জন্য সংশ্লিষ্টদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা দেখেছি নির্বাচন কমিশনের সার্ভার থেকে কীভাবে তথ্য পাচার হয়েছে, বিক্রি হচ্ছে। এসবের পরও ওই একই বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের কাছেই নাগরিক তথ্য তুলে দেওয়া হয়েছে কোনো প্রকার টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়া। এ বিষয়গুলো নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য পুনরায় ভাবা দরকার।