প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে মাঝে মাঝেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা মিলছে দুর্বৃত্তদের। তারা হামলে পড়ছে প্রতিপক্ষ কিংবা সাধারণ মানুষের ওপর। সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য ভেদ করা বুলেটে সাধারণ মানুষের নির্মম মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। আবার দুর্বৃত্তের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে লিপ্ত হচ্ছে চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্যসহ নানা অপরাধে। এদের অনেকেই পতিত সরকারের অনেক নেতার অধীনে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। তবে দলীয় পরিচয় দেখে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে সমাজে। উল্টো অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ইসরাইল হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে বিভিন্ন জায়গায় পোলারাইজেশন হচ্ছে এমন তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। বিগত সরকার আমলের দুর্বৃত্তদের শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা চলছে, সব খবরই আমরা পাচ্ছি। দুর্বৃত্তদেরও আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা চলছে। যৌথ বাহিনীর অপারেশনও অব্যাহত রয়েছে।’ গত বুধবার দুপুরে পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধে ২০-৩০ জন মিলে এক ব্যক্তিকে মারধর করছিলেন। নারীসহ স্থানীয় লোকজন মারধরের শিকার ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। এতে আয়েশা আক্তার (২৬) নামে এক নারী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পুলিশ বলছে, স্থানীয় মোমিন ও মামুন গ্রুপের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন। এরা চিহ্নিত মাদক কারবারি। ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় ধানমন্ডি ৮/এ সড়কের মাথায় হঠাৎ হেলমেট পরিহিত চার দুর্বৃত্ত রাসেল নামে এক পথচারীকে জাপটে ধরে। তিনি ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন ফাঁকা গুলি করে। ব্যাগটি কেড়ে নিয়ে চারজন মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। ভুক্তভোগী রাসেল সাতমসজিদ সড়কের কেয়ারি প্লাজায় অবস্থিত বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ব্যুরো ডি চেঞ্জের ব্যবস্থাপক। তাঁর অভিযোগ, ব্যাগে ছিল প্রতিষ্ঠানের ৫০ লাখ টাকা, যা ওই দুর্বৃত্তরা নিয়ে যায়।
ওপরের দুটি ঘটনার মতো দেশের বিভিন্ন এলাকায় হামেশাই দুর্বৃত্তদের তৎপরতা বাড়ছে। ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকায় প্রকাশ্যে ভারী অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় একদল দুর্বৃত্ত। এক ব্যবসায়ীর কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে অস্ত্র নিয়ে সেখানে হামলা চালায়। সাজ্জাত বাহিনীর সন্ত্রাসকাে র প্রতিবাদ করায় সোমবার চট্টগ্রামে দিনদুপুরে আফতাব উদ্দিন তাহসীন নামে এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানান, এখনো অনেক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে থানা থেকে লুট হওয়া বেশির ভাগ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। সেসব অস্ত্রও সন্ত্রাসকাে ব্যবহার করা হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়িতে প্রকাশ্যে গুলির ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। গত অক্টোবরে দেশে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সারা দেশেই প্রতিদিন হত্যা, হামলা, ভাঙচুর, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ঘটছে। মানুষ এসব কারণে স্বস্তিতে নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে। নইলে পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। কারণ এর সুযোগ নেবে দেশিবিদেশি নানা মহল।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর পতিত সরকারের রেখে যাওয়া প্রশাসন যথাযথ কাজ করতে পারছে না। অন্তর্বর্তী সরকারও কঠিন বার্তা দিতে পারছে না। এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে দেশিবিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা।’
সরকার পতনের পর গত তিন মাসে অন্তত ৭১৫ জনের বেশি মানুষ হত্যার শিকার হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১১ হাজার। এর মধ্যে অক্টোবরে ৯১, আগস্টে ৫৪১ ও সেপ্টেম্বরে ৮৪ জন নিহত হন। এ ছাড়া গত তিন মাসে গণপিটুনিতে ৮৪ জন নিহত হন। পুলিশ, হাসপাতাল ও মানবাধিকার সংস্থা এমএসএফের তথ্য এগুলো।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করেছে। অভিযানে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৩১৮টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭৪ সন্ত্রাসী। উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে রিভলবার ১৯, পিস্তল ৭৬, রাইফেল ২২, শটগান ৩৭, পাইপগান ৮, শুটার গান ৪৩, এলজি ৩১, বন্দুক ৪৮, একে-৪৭ একটি, এসএমজি ৫, গ্যাসগান ৪, এয়ারগান ১০, এসবিবিএল ১০, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ২ ও থ্রি-কোয়ার্টার ২টি।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অক্টোবরে গণপিটুনিতে হতাহত উদ্বেগজনকভাবে ঘটেছে। এ মাসে অন্তত ২৪টি গণপিটুনির ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। গত দুই মাসে এ সংখ্যা ছিল ৬৫।
এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্টোবরে ৫৮টি রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪২৪ জন। তার মধ্যে ১২ জন নিহত ও ৪১২ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে নয়জন আওয়ামী লীগের কর্মী বা নেতা। বাকি নিহত তিনজন বিএনপির। আহতের মধ্যে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ। সহিসংতার ৫৮ ঘটনার মধ্যে ৩৭টি বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলজনিত, ১৭টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে, দুটি আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল, দুটি ঘটেছে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ৫ আগস্ট পূর্বাপর দেশে ৪৪ পুলিশ সদস্য নিহত হন। আহত হন সহস্রাধিক। পুলিশ দায়িত্বে ফিরলেও এখনো স্বাভাবিক হয়নি দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এখনো হত্যাকাে র শিকার হচ্ছে পুলিশ। সর্বশেষ কুষ্টিয়ায় দুই পুলিশকে পিটিয়ে নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়। এর আগে রাষ্ট্রপতির অপসারণ দাবিতে গণভবনের সামনে সংঘর্ষে ২৫ পুলিশ সদস্য আহত হন।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে গুলিতে দুই পোশাকশ্রমিক আহত হন। এ সময় সংঘর্ষে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পোশাকশ্রমিকরা পুলিশের একটি ও সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। গুলিবিদ্ধ পোশাকশ্রমিক আল আমিন (১৮) ও ঝুমা আক্তারকে (১৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
একাধিক সূত্র বলছেন, বেশির ভাগ চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি ঘটছে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত। তিন মাসে যেসব ছিনতাই ঘটেছে সবই এ সময়ে। এর মধ্যে ডাকাতির ঘটনা বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, সড়ক, বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তারা বেশি হানা দিয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের গ্রাহকদেরও টার্গেট করা হচ্ছে। আর ভোরের দিকে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও নিরিবিলি-অন্ধকার সড়কে রিকশাযাত্রীদের নিশানা বানিয়েছে ছিনতাইকারীরা।
ডিএমপির তৈরি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছিনতাইকারী বেশি রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শাহবাগ, ভাটারা, বাড্ডা, শেরেবাংলানগর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, হাতিরঝিল, মিরপুর, পল্লবী, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায়। এসব অপরাধে জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্তও রয়েছে।
পুলিশ মাঠ পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছে, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে তেজগাঁও বিভাগে। সবচেয়ে কম মিরপুর বিভাগে। থানার তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে শাহবাগ, ভাটারা ও শেরেবাংলানগর থানা এলাকায়। আর সবচেয়ে কম ছিনতাইকারী ও ডাকাতের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে দক্ষিণখান, উত্তরখান ও উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায়।
এ ছাড়া বিভাগীয় ও জেলা শহরে এখন অনেকের হাতেই অবৈধ অস্ত্র দেখা যাচ্ছে। পুলিশ যেহেতু এখনো ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে কারণে সাহস করে এসব অস্ত্র উদ্ধারে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সর্বপ্রথম অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এ ছাড়া পুলিশ ইচ্ছা করলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবে না।