এক জয়ে দেশজুড়ে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ফুটবল ইতিহাসে বাংলাদেশ জাতীয় দল বড় কোনো শিরোপা জিতেছে। বলছি মঙ্গলবার ঢাকায় হওয়া বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের কথা। ১-০ গোলে জয়লাভ করেছে লাল-সবুজের দল। তারপরও কোনো লাভ নেই। এশিয়ান কাপ চূড়ান্ত পর্বের খেলা আগেই শেষ হয়ে গেছে তাদের। এখন শুধু অপেক্ষা গ্রুপে ভারতের ওপরে থেকে মিশন শেষ করতে পারবে কি না বাংলাদেশ। অথচ এক জয় নিয়ে এখানো দেশে উৎসবের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। গতকাল মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ১০০তম টেস্ট খেললেন। শুধু তাই নয় শততম টেস্টেও শতক হাঁকানোর পথে। আজ এক রান করলে আরেক ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবেন তিনি।
দিনটি অবশ্যই ছিল মুশফিকের। কিন্তু ঢাকায় আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট নিয়ে আলোচনা হয়েছে কতটুকু? গ্যালারিতে দর্শকই বা কেমন ছিল তা তো দেখায় গেছে। মঙ্গলবার ভারতের বিপক্ষে জয় নিয়ে গতকালও ছিল আলোচনা তুঙ্গে। জয়ে কোনো ট্রফি বা শিরোপা জেতা হয়নি। তারপরও যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বাংলাদেশ দলকে ২ কোটি টাকার পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পুরুষ বা নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও এত টাকার পুরস্কার দেওয়া হয়নি কখনো।
তাহলে এক জয়ে ২ কোটি টাকার পুরস্কার দেওয়া হলো কেন? আসলে এ এক জয়ই শিরোপার চেয়ে দামি হয়ে উঠেছিল। আর তা প্রতিবেশী ভারতকেই ঘিরে। কাছের দেশ হলেও বরাবরই দুই দেশের খেলা নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে থাকে। সেটা ফুটবল বা ক্রিকেট হোক। তা ছাড়া খেলার মান প্রায় সমান হওয়ার পরও ফুটবলে কোনোভাবেই ভারতকে হারানো যাচ্ছিল না। ২২ বছর ধরে অধিকাংশ খেলায় হার বা ড্র এমন বিপর্যয়েই ছিল বাংলাদেশ।
যে কোনো ফুটবল আসরে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ জয় পেয়েছিল ২০০৩ সালে। সেবার সাফ ফুটবলের সেমিফাইনালে রোকনুজ্জামান কাঞ্চন ও মতিউর মুন্নার গোলে ২-১ ব্যবধানে ভারতকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেই ম্যাচটিও তৎকালীন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে (বর্তমান ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়াম)। শেখ মোরসালিনের দুরন্ত গোলে জেতার পরও তো কোনো সেমিফাইনাল বা ফাইনালে জায়গা পেল না। অথচ হামজা ও ফুটবলপ্রেমীদের সে কি বাঁধ ভাঙা উল্লাস। তাতে মনে হলো ফুটবল ইতিহাসে সেরা জয়টা পেয়ে গেল। এমন তো না যে ভারত কখনো হারেনি। তবে আগের জয় আর এবারের জয়ে পার্থক্য অনেক। আগের তিন জয় ছিল কাছাকাছি সময়ে। ১৯৯১ সাফ গেমসের পর ১৯৯৯ সাফ গেমসে তারপর তৃতীয়টি এসেছিল ২০০৩ সালে। চতুর্থ জয় পেতেই ২২ বছরের অপেক্ষা। খেলার হারজিত হবেই। কিন্তু বাংলাদেশ জিততে পারে না বলে ভারতের কী যে তিরস্কার। তাদের অনেক বিখ্যাত ফুটবলারই বলেছেন, বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতীয় জাতীয় দল খেলানো অর্থই হয় না। ছোটদের খেলাতে পারে। পাচ্ছিল না বলে এসব অপমান নীরবে সহ্য করেছে বাংলাদেশ।
হামজা দেওয়ান চৌধুরী যোগ দেওয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন ফুটবলপ্রেমীরা। আশা ছিল এবার ভারতকে হারিয়ে অপমানের জবাব দেওয়া হবে। এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে গ্রুপের প্রথম ম্যাচটিও ছিল ভারতের বিপক্ষে। তাও আবার তাদের মাটি শিলংয়ে। হামজার অভিষেকেই ভারতকে আমরা ভারতের মাটিতে হারাব এ ছিল প্রত্যাশা। দুর্ভাগ্য সহজ সুযোগ নষ্ট করায় জেতা ম্যাচে পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে হয়। এরপর অপেক্ষায় ছিল ১৮ নভেম্বর। মার্চ ২৬ থেকে নভেম্বর ১৮ সময় অনেক। তারপরও ফুটবলপ্রেমীদের ভাবনায় ছিল ঢাকায় ভারত ম্যাচ। সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের কাছে হেরে চূড়ান্ত পর্বের খেলার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের। আসল উত্তেজনাটা ছিল ভারত ম্যাচ ঘিরেই।
হামজা, সামিত, ফাহমিদুল, জায়ানদের মতো প্রবাসী ফুটবলাররা খেলার পরও বাংলাদেশ যদি জয় না পায় তা তো খারাপ লাগবেই। হামজাদের প্রতিজ্ঞা ছিল জয় পেতেই হবে আর তা ভারতের বিপক্ষে। শেষ পর্যন্ত ২২ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটেছে ঢাকা স্টেডিয়ামেই। রাকিবের চমৎকার পাসে শেখ মোরসালিন দারুণ গোল করেছেন। যা ভারতের বিপক্ষে অন্যতম সেরা গোল। কথা হচ্ছে এ ঐতিহাসিক জয়ের পর বাংলাদেশ সামনে এগোবে কি? জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক কায়সার হামিদ বলেন, ‘হামজা, সামিতরা আসার পর ফুটবলের চেহারা বদলে গেছে। অন্য এক বাংলাদেশের দেখা মিলছে। সে সঙ্গে অনেক দিন পর ভারতকে হারালো। বন্ধ দুয়ার খোলার পর এখন সামনে তাকাতে হবে। আর যেন ২২ বছর অপেক্ষা করতে না হয় সেটাই প্রত্যাশা।’