অনিয়ম করে মুক্তিযোদ্ধা চাচাকে বাবা বানিয়ে কোটায় চাকরি নিয়েছেন অনেকেই। যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়েছেন প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে তাদের ৩ থেকে ৪ শতাংশের তথ্যের গরমিল পেয়েছে মন্ত্রণালয়। দেশে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অধীন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি করছেন ৮৯ হাজার ২৮৬ জন। তাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। বাকিদের যাচাই-বাছাই চলমান রয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষ হলে কোটায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরিরতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বিগত সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রায় ৩০ হাজার ব্যক্তি নিয়োগ পেয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে। সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জননিরাপত্তা বিভাগ ও বাংলাদেশ পুলিশে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে তাদের ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সরকারি চাকরির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে কোটা চালু করে সরকার। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার এসব সনদ যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নেয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এরই মধ্যে ৫৮টি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং এর অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরতদের তথ্য জমা পড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ না করে অনেকে প্রভাব খাটিয়ে ও দুর্নীতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন। অনেকে ভুয়া সনদ তৈরি করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার বয়স নিয়েও বিভিন্ন সময় নানা প্রশ্ন উঠেছে। চার থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার নজির রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং আগের সব সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা মুক্তিযুদ্ধ না করে ক্ষমতার প্রভাবে তাদের বাবা, চাচা, ভাই ও নিজের নামে সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অভিযোগ বহু রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়েছেন, এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৮৯ হাজার ২৮৬ জন। তাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান। ইতোমধ্যেই ৫০ হাজারের মতো যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। এটা প্রাথমিক যাচাই-বাছাই, চূড়ান্ত নয়। এরপর অধিকতর যাচাই-বাছাই করা হবে। এই প্রাথমিক বাছাইয়ে বেশ কিছু গরমিল পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করেনি। অনেকেই চাচাকে বাবা দেখিয়ে চাকরি নিয়েছেন। এ ধরনের গর্হিত অপরাধের জন্য আমরা সরকারের নির্দেশনায় একটা সুপারিশ দেব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোয়। তারা তাদের কর্মকর্তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।
এর আগে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছিলেন, সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কতজনের চাকরি হয়েছে, এর একটি তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ না করে যারা মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর থেকে কাজ শুরু করে মুুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। যাচাই-বাছাই কমিটিতে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যাদের তথ্যের গরমিল আছে তাদের নামের তালিকা করা হচ্ছে। এই তালিকা নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে পাঠানো হবে। তবে তালিকা চূড়ান্ত নয়। এখন প্রাথমিক যাচাই-বাছাই চলছে। এতেই ৩ থেকে ৪ শতাংশ চাকরিজীবীর তথ্যের গরমলি পাওয়া গেছে। অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়ে এখন পর্যন্ত যারা যথাযথ প্রমাণাদি জমা দেননি, তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত (অ্যান্ট্রি) করা হচ্ছে। তাদের কাগজপত্র জমা দিতে বলবে মন্ত্রণালয়। যারা প্রমাণাদি দিতে ব্যর্থ হবেন তাদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় যুক্ত করবে মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে। একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি অনেকের তথ্যের গরমিল পেয়েছে মন্ত্রণালয়। গরমিল পাওয়া তথ্যের মধ্যে রয়েছে, তথ্য গোপন করা, নাম-ঠিকানা ভুল দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা চাচাকে বাবা বানিয়ে কোটায় চাকরি নেওয়া, গেজেট হওয়ার আগেই চাকরি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি, মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর বারবার নির্দেশনা দেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধার প্রমাণাদি কাগজপত্র জমা না দেওয়া। যাচাই-বাছাই কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের উপসচিবসহ প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন।
কমিটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চাকরিরতদের তথ্যাদি যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রতিবেদন তৈরি করবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে যারা জালিয়াতি করে নিয়োগ পেয়েছেন বলে প্রমাণিত হবেন, তাদের বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিষয়। এ জন্য প্রতিবেদনটি অনুমোদনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। বৈঠকে যারা ভুয়া সনদ দেখিয়ে চাকরি নিয়েছেন; চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি তাদের দেওয়া বেতন-ভাতা ফেরত নেওয়া এবং প্রতারণার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলার করা হবে কি না এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাওয়া হবে বলে জানা গেছে।